ইরানের ফোরদো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনায় বাঙ্কার ব্লাস্টার বোমা দিয়ে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল পর্বতের নিচে এবং একে ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনা বলে বিবেচনা করা হত। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর এই পারমাণবিক কেন্দ্রের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে স্যাটেলাইট চিত্রে।
গুরুত্বপূর্ণ এই পরমাণু স্থাপনাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরের স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, পর্বতের গায়ে বড়বড় কিছু গর্ত তৈরি হয়েছে এবং একাধিক জায়গায় ভূমি দেবে গেছে। এছাড়া টানেলের মুখ মাটিচাপা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার আলামত পাওয়া গেছে।
হাই-রেজুলিউশন স্যাটেলাইট চিত্রে কী দেখা গেছে?
হামলার আগের ও পরের উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাগুলো। তারা বলছেন, হামলার পরের ছবিতে দেখা গেছে—দুইটি স্থানে সম্ভবত বোমার আঘাতে ভূমি দেবে গেছে, এবং টানেলের প্রবেশপথগুলো মাটি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব চিত্র হামলার তীব্রতা ও লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণের বিষয়টি স্পষ্ট করে।
হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্রকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এখন আর ইরানের দিক থেকে কোনো পরমাণু হুমকি নেই এবং এখন শান্তির সময়।
তবে ইরানের দাবি করছে, হামলার আগেই এসব পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু উপকরণ ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলেছিল তারা। সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামসহ কোনো ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান সেখানে রাখা ছিল না, যাতে হামলার ফলে বিকিরণ ছড়ায় বা সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
হামলার দুইদিন আগের স্যাটেলাইট চিত্র ইরানের এই দাবিকে আরও জোরালো করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উপগ্রহ চিত্র সংস্থা ম্যাক্সার গত ১৯ ও ২০ জুন উচ্চমানের স্যাটেলাইট ছবি তুলেছে, যেখানে ফোরদো এলাকার প্রবেশপথ ও টানেল সংলগ্ন এলাকায় অস্বাভাবিক যানবাহন চলাচলের প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, অন্তত ১৬টি মালবাহী ট্রাক ফোরদোর অ্যাক্সেস রোড বরাবর সারিবদ্ধভাবে অবস্থান করছে, যেগুলো সরাসরি টানেলের প্রবেশপথের দিকে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশিরভাগ ট্রাক প্রবেশপথ থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সরিয়ে নেওয়া হয়, যা ইঙ্গিত দেয় কোনো ধরনের স্থানান্তর বা রক্ষণমূলক প্রস্তুতি চলছিল। ছবিতে বুলডোজার, ট্রাক এবং অতিরিক্ত যানবাহনও দেখা গেছে, যা প্রতিরক্ষা বা সরবরাহ অপসারণসংক্রান্ত সক্রিয়তার ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই তৎপরতা যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কদিন আগেই দেখা গেছে, যা বোঝায় তেহরান হয়তো উপগ্রহ নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা চালিয়েছিল। অন্য এক ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, ইরান হয়তো হামলার পূর্বাভাস আগেই পেয়েছিল এবং সে অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও উপকরণ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়।
যে বোমা দিয়ে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলায় GBU-57 নামের বাংকার-ব্লাস্টার বোমা ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী বোমালোর একটি। এর ওজন প্রায় ৩০,০০০ পাউন্ড (১৩,৬০০ কেজি) এবং এটি ২০০ ফুট (প্রায় ৬১ মিটার) গভীর ভূগর্ভে প্রবেশ করে বিস্ফোরিত হতে পারে। বিশেষভাবে এমন স্থাপনা ধ্বংসের জন্য এই বোমা ডিজাইন করা হয়েছে, যেগুলো পাহাড় বা পাথরের নিচে নির্মিত।
প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, ফোরদো স্থাপনায় ইরান ৮৩.৭ শতাংশ বিশুদ্ধতায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে, যেখানে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করতে প্রয়োজন ৯০ শতাংশ বিশুদ্ধতা। এই প্রক্রিয়াজাত ইউরেনিয়াম ছড়িয়ে পড়লে তা মারাত্বক ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে আনার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আইএইএ জানিয়েছে, এখনও তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার কোনা লক্ষণ দেখা যায়নি।
হামলার প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ফোরদো স্থাপনার গঠন এতটাই সুরক্ষিত ও জটিল যে হামলার প্রকৃত প্রভাব জানতে কয়েকদিন কিংবা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।
মন্তব্য করুন