ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি ইরানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রেক্ষাপটে দেশবাসীকে বলিষ্টভাবে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছেন। তবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হয়ে ওঠার তার এই পথ মোটেও সহজ ছিল না।
আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির জীবন কঠিন সংগ্রামে পরিপূর্ণ। তিনি একসময় শাহ রেজা পাহলভির আমলে প্রায় আট মাস কারারুদ্ধ ছিলেন। তিনি নিজেই সেই সময়কে তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। খামেনির সেই কারাজীবন নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই কারাগারটি বর্তমানে ‘এব্রাত জাদুঘর’ নামে পরিচিত। রাজধানী তেহরানে অবস্থিত এই স্থানটি একসময় ছিল ইরানের কুখ্যাত রাজনৈতিক কারাগার। এখানে শুধু খামেনি নন, অসংখ্য ইসলামপন্থি বিপ্লবী, আলেম, নারী অধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক নেতাও আটক ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
‘সাবাক’-এর বর্বরতা ও খামেনির বন্দিজীবন
১৯৬০ ও ’৭০-এর দশকে খামেনি ইসলামি বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এর জেরেই তিনি শাহের গোপন পুলিশ সংস্থা সাবাক (SAVAK)-এর হাতে ছয়বার গ্রেপ্তার হন। সর্বশেষ ১৯৭৫ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে তেহরানের ‘জয়েন্ট কমিটি এগেইনস্ট সাবোটাজ’ নামক কারাগারে পাঠানো হয়, যা এখন এব্রাত জাদুঘর। এই সময় তার মাশহাদের বাসায় অভিযান চালিয়ে সমস্ত কোরআন শিক্ষার বই ও নোট জব্দ করা হয়।
তিনি ওই বন্দিজীবনকে বর্ণনা করেন ‘মানবতার বিরুদ্ধে এক নিষ্ঠুর অধ্যায়’ হিসেবে। সেখানে তাকে ছোট একটি সেলে রাখা হতো, যেখানে আলো ঢুকত মাত্র একটি জানালার ফাঁক দিয়ে। বর্তমানে সেই কক্ষে খামেনির মোমের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে তিনি কালো পাগড়ি, গোল চশমা ও বাদামি চাদর পরে আছেন।
বিপ্লবের পথে খামেনির সংগ্রাম
১৯৬২ সালে আলী খামেনি ইমাম রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে শাহের আমেরিকান-সমর্থিত ও ইসলামবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি ইমামের বার্তা ইরানের বিভিন্ন আলেমদের কাছে পৌঁছে দিতেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি মাশহাদের বিভিন্ন মসজিদে কোরআন, ইসলামি আদর্শ ও ‘নাহজুল বালাগা’ নিয়ে বক্তৃতা দিতেন, যা তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সাবাক তাকে ফের গ্রেপ্তার করে।
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর তিনি দ্রুত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্তরে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তাকে প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয় এবং তেহরানে শুক্রবারের খুতবা পাঠের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা আজও তিনি পালন করে চলেছেন। ১৯৮৯ সালে ইমাম খোমেনির মৃত্যুর পর তিনি সর্বোচ্চ নেতা নিযুক্ত হন।
এব্রাত জাদুঘর : এক ভয়াবহ অতীতের স্মৃতিবহ স্থান
এব্রাত জাদুঘর (Muze-ye Ebrat) শুধু একটি জাদুঘর নয়, বরং এটি ইতিহাসের এক গা শিউরে ওঠা অধ্যায়কে তুলে ধরার অনন্য স্থাপনা। এটি ১৯৩২ সালে শাহ রেজা পাহলভির আদেশে জার্মান প্রকৌশলীদের মাধ্যমে নির্মিত হয় এবং ইরানের প্রথম আধুনিক কারাগার হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। প্রথমে এটি নারী কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পরে ‘সাবাক’-এর অধীনে রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর নিপীড়নের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
১৯৭৯ সালে বিপ্লবের পর এটি ‘তোহিদ কারাগার’ নামে পরিচিতি পায় এবং ২০০০ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। পরে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপে ২০০২ সালে এটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়।
কারাগারের গঠন ও নির্মাণশৈলী
এই চারতলা ভবনটি ভূমিকম্প-প্রতিরোধী এবং বন্দিদের পলায়ন ঠেকাতে বিশেষভাবে নকশা করা হয়। একটি গোলাকৃতির খোলা ছাদ বিশিষ্ট চত্বর ঘিরে চারদিকে করিডোর গড়ে তোলা হয়, যাতে সবকটি সেল সেই চত্বরে মিলিত হয়। দেয়ালগুলো এমনভাবে নির্মিত যে বন্দিদের চিৎকার বাইরে পৌঁছাত না।
জাদুঘরে রয়েছে বিচ্ছিন্ন ও সাধারণ সেল, নির্যাতন কক্ষ, বন্দিদের সাক্ষাতের ঘর ও পোশাক রাখার জায়গা। এই সব স্থান আজও সেই সময়ের অমানবিক নির্যাতনের নিদর্শন বহন করে।
জাদুঘরের প্রধান আকর্ষণ ও প্রদর্শনী
মোমের মূর্তি ও দৃশ্যাবলি : কারাবন্দিদের ওপর চালানো নির্যাতনের দৃশ্য, রক্তের ছোপ, প্রহারের দৃশ্য মোমের মূর্তির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ভিডিও ডকুমেন্টারি : সাবেক বন্দিদের সাক্ষাৎকারসহ একটি ছোট তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এতে ইংরেজি সাবটাইটেলও রয়েছে।
সাবেক বন্দিদের পরিচালিত ট্যুর : এক ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতা হলো—কিছু ট্যুর গাইড নিজেরাই এই কারাগারের সাবেক বন্দি। তাদের বর্ণনায় নির্যাতনের বাস্তব চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ছবি ও দলিলাদি : সাবাকের বর্বরতা ও রাজতন্ত্রের শাসনামলের চিত্র তুলে ধরতে অসংখ্য ফটোগ্রাফ ও নথিপত্র প্রদর্শন করা হয়।
মন্তব্য করুন