ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের অন্যতম বৈজ্ঞানিক ও সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তেল আবিবের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রেহোভোতে অবস্থিত এই ইনস্টিটিউটটির পতন ইসরায়েলের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। কারণ এটিকে ইসরায়েলের আধুনিক সামরিক প্রযুক্তির মূল ভিত্তি বা ‘প্রযুক্তির মেরুদণ্ড’ হিসেবে দেখা হতো।
ইরানের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রেস টিভির এক প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ইসরায়েলি শাসনব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক ও সামরিক গবেষণার মূল ভিত্তি হিসেবে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানটি এখন কার্যত অচল ও বিধ্বস্ত।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শুধু ইনস্টিটিউটের স্থাপনা নয়, কয়েক দশকের গবেষণা, কোটি কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি এবং বহু জীববৈজ্ঞানিক নমুনা, উপাত্ত ও পেটেন্টের সম্ভাবনাও পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। তারা বলছেন, এটি ইসরায়েলের জন্য একটি বড় দুর্ভাগ্য যে, ইসরায়েলের বহু বছরের সাধনা এভাবে মুহূর্তে মাটিচাপা পড়ে গেছে।
‘সুনির্দিষ্ট হামলা, কোনো দুর্ঘটনা নয়’
প্রেস টিভি তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, ইরান অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্টভাবে এই হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলোও ইরানের সুনির্দিষ্ট এই হামলাকে 'ভুল করে আক্রমণ' হিসেবে দেখছে না। বরং সব তথ্য-উপাত্ত থেকে স্পষ্ট যে, ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউট ছিল ইরানের একটি ‘টার্গেটেড স্ট্রাইক’।
ইসরায়েলি টেলিভিশন চ্যানেল ১৩-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট আলোন চেন স্বীকার করেছেন যে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইনস্টিটিউটের হৃৎপিণ্ডে আঘাত করেছে। হামলা এতটাই নিখুঁত ছিল যে, পুরো বৈজ্ঞানিক কমপ্লেক্স ধ্বংস হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ মিলিয়ন ডলার থেকে অর্ধ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। অনেক মূল্যবান গবেষণা স্থায়ীভাবে হারিয়ে গেছে।
চেন জানান, ইনস্টিটিউটজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৪৫টি ল্যাব ধ্বংস হয়েছে এবং এতে প্রায় ৪০০-৫০০ গবেষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত ছবি ও ভিডিও প্রকাশে ইসরায়েলি সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করায় প্রকৃত চিত্র সামনে আসেনি। তেল আবিব আশঙ্কা করছে, প্রকৃত তথ্য জানাজানি হলে ইরান ভবিষ্যতে আরও নিখুঁত হামলার সুযোগ পাবে।
২০ বছরের গবেষণার ফসল মুহূর্তে শেষ
ইরানের হামলায় বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হলেন অধ্যাপক এলদাদ জাহর, যিনি হৃদযন্ত্র পুনর্জন্ম (cardiac regeneration) প্রযুক্তি নিয়ে ২২ বছর ধরে গবেষণা করছিলেন। তার ল্যাবে থাকা হাজার হাজার হৃৎপিণ্ডের টিস্যু, ডিএনএ ও আরএনএ নমুনা, অ্যান্টিবডি ও ল্যাব-প্রস্তুত ভাইরাস সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে।
তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ল্যাবটি আমার দ্বিতীয় বাড়ি ছিল। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে আগুন সেটিকে ধ্বংস করে দিল। আমি কিছুই বাঁচাতে পারিনি—নোট নেই, ডেটা নেই, এমনকি একটিও ছবি পর্যন্ত নেই।’
হামলায় ইনস্টিটিউটের ৪৫টিরও বেশি ল্যাবরেটরি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ল্যাবে কাজ করছিলেন ৪০০-৫০০ বিজ্ঞানী ও গবেষক। ধ্বংস হওয়া ল্যাবগুলোতে ক্যান্সার, কোষ পুনর্গঠন, জিন গবেষণা, জীবাণুবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান ও রসায়নসহ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চলছিল।
এ ছাড়া, একটি সম্পূর্ণ নতুন রাসায়নিক ও পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগার—যেটি এ বছর চালু হওয়ার কথা ছিল—সেটি পুরোপুরি গুঁড়িয়ে গেছে। জীববিজ্ঞান ও গণনামূলক বিজ্ঞান ভবনগুলোতেও আগুন লেগেছে এবং কয়েকটি তলায় ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই।
সামরিক-শিল্প জোটের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক
ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউট শুধু একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং ইসরায়েলের সামরিক শিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এমন একটি সংস্থা, যেখান থেকে ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার যুদ্ধ, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বিকল্প জিপিএস প্রযুক্তি এবং এমনকি পারমাণবিক গবেষণার মতো উচ্চ-প্রযুক্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
২০২৪ সালের অক্টোবরে ইনস্টিটিউট এলবিট সিস্টেমসের সঙ্গে একটি যৌথ চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার আওতায় ‘জীব-অনুপ্রাণিত সামরিক উপকরণ’ উদ্ভাবনের কাজ চলছিল। ইনস্টিটিউটের গবেষণাগুলোর অনেক গবেষক ইসরায়েলের সিগন্যাল ও সাইবার যুদ্ধ বিভাগ ‘ইউনিট ৮২০০’ ও সামরিক বিশেষজ্ঞ তৈরির ‘তালপিয়ট প্রোগ্রামে’ অংশ নিয়েছেন।
অধ্যাপক ইরান সেগালের মতো গবেষকরা গাজা ও ইরানসংক্রান্ত আগ্রাসনের সময় সেনাবাহিনীকে রিয়েল-টাইম সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে অ্যালগরিদম তৈরিতে কাজ করেছেন।
ইতিহাসের গহিনে সামরিক সম্পৃক্ততা
ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউটের সামরিক সংশ্লিষ্টতা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালের নাকবার সময় এই ইনস্টিটিউটের গবেষণা ও যন্ত্রপাতি সরাসরি জায়নিস্ট সশস্ত্র সংগঠন হাগানাহ-এর কাজে ব্যবহার করা হয়। পরে এটি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সমরাস্ত্র গবেষণার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা আর্নস্ট ডেভিড বার্গম্যান ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির স্থপতি হিসেবে পরিচিত। তিনি ১৯৫২ সালে ইসরায়েলের পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউটের অনেক বিজ্ঞানী ইসরায়েলের গোপন পরমাণু কেন্দ্র ডিমোনা-তেও কর্মরত ছিলেন।
২০১৪ সালে তেল আবিব ও সিনসিনাটির এক যৌথ গবেষণায় দাবি করা হয়, ইনস্টিটিউটটি পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে। এফবিআইর একাধিক তদন্তেও ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউটের যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সিস্টেমে অনুপ্রবেশের প্রমাণ মিলেছে।
ইসরায়েলের ন্যারেটিভ বদলে দেওয়ার চেষ্টা
বিগত কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলি মিডিয়া ও সরকার ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউটকে তাদের ‘বৈজ্ঞানিক ও সামরিক মস্তিষ্ক’ হিসেবে উল্লেখ করে আসছিল। কিন্তু ইরানের হামলার পর তারা একে আবার ‘সাধারণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে উপস্থাপন করছে, যেন এটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলার লক্ষ্য হিসেবে দেখানো না যায়।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের এই সুনির্দিষ্ট হামলা শুধু একটি গবেষণাগারে আঘাত নয়—এটি ইসরায়েলের প্রযুক্তিগত ও সামরিক সক্ষমতায় বড় রকমের কৌশলগত ধাক্কা। এটা স্পষ্ট করে যে, ইসরায়েলের সবচেয়ে সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানও ইরানের নজরদারির বাইরে নয়।
মন্তব্য করুন