কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৫, ০১:৪২ এএম
আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২৫, ০৭:০৬ এএম
অনলাইন সংস্করণ

‘পাগল তত্ত্ব’ ব্যবহার করে বিশ্বকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি : সংগৃহীত
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা হচ্ছে, তিনি তার চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করেন। তিনি স্ববিরোধী কাজ করেন। তার কথা আর কাজে মিল নেই। অর্থাৎ তার অননুমেয় আচরণ যেন স্বাভাবিক।

ট্রাম্প প্রায় এমন আচরণ করে আসছেন। তবে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সময় তা যেন প্রতিষ্ঠিত রূপ পায়। বিশ্ব মোড়লের ভূমিকায় থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অননুমেয় আচরণ সামনে এনেছে ‘পাগল তত্ত্ব’, যা নিয়ে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্লেষণ চলছে।

গত মাসে ট্রাম্পের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ইরানে হামলায় তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন কি না। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এটা করতে পারি। আবার আমি না-ও করতে পারি। আমি কী করতে যাচ্ছি, তা কেউই জানে না।’

ট্রাম্প বিশ্বকে এমনটা বিশ্বাস করতে দিয়েছিলেন যে, ইরানকে আলোচনা শুরুর সুযোগ দিতে দুই সপ্তাহ হামলা স্থগিত রাখার বিষয়ে তিনি সম্মত হয়েছেন। কিন্তু পরে এ সময়ের মধ্যেই তিনি হামলা চালিয়ে বসেন।

ট্রাম্প তার এই বৈশিষ্ট্যকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে আসছেন। তিনি তার নিজের অননুমেয় আচরণকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও রাজনৈতিক সম্পদে পরিণত করেছেন। তিনি এই অননুমেয় আচরণকে একটি মতবাদ বা নীতির পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আর এখন যে ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য তিনি হোয়াইট হাউসে নিয়ে এসেছেন, সেটিই পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি বিশ্বব্যবস্থার বিদ্যমান কাঠামো পাল্টে দিচ্ছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এটিকে ‘ম্যাডম্যান থিওরি’ বা ‘খ্যাপাটে তত্ত্ব’ বলে থাকেন। এই তত্ত্বে একজন বিশ্বনেতা তার প্রতিপক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি নিজের মেজাজ-মর্জিমতো যে কোনো কিছু করতে সক্ষম, যাতে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা যায়। সফলভাবে ব্যবহার করা হলে এটি এক ধরনের জবরদস্তি বা চাপ প্রয়োগের কৌশল হতে পারে। ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, এটি সুফল দিচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের তার পছন্দমতো অবস্থানে নিয়ে আসতে পারছেন।

বিবিসিতে প্রকাশিত অ্যালেন লিটলের এক লেখায় ‘ম্যাডম্যান থিওরি’ কীভাবে ট্রাম্প কাজে লাগাচ্ছেন তা তুলে ধরেন। তিনি লিখেন, ‘কথার আক্রমণ, অপমান ও কাছে টানা’ ট্রাম্পের অন্যতম কৌশল। আমেরিকার মিত্রদের কথার আক্রমণ যেন দুধভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি কানাডাকে অপমান করে বলেছিলেন, দেশটির যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য হয়ে যাওয়া উচিত। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে কাছে টেনে নেন তিনি।

সামরিক জোট ন্যাটো সনদের ৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি সদস্য দেশ অন্য দেশকে রক্ষায় এগিয়ে আসার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের এ অঙ্গীকারকে সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেন। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘আমি মনে করি, (ন্যাটো সনদের) ৫ অনুচ্ছেদ লাইফ সাপোর্টে আছে।’

ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ইউরোপের মিত্রদের অপমান করার সংস্কৃতি ফাঁস হওয়া বেশ কিছু খুদেবার্তার মাধ্যমে সামনে এসেছে। নিজের সহকর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, ‘ইউরোপের একচেটিয়া সুবিধাভোগীদের প্রতি আপনাদের অবজ্ঞা আমি পুরোপুরি সমর্থন করি।’

ট্রাম্পের কৌশল কাজে দিয়েছে। মাত্র চার মাস আগে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে বলেছিলেন, যুক্তরাজ্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করবে।

গত মাসে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে এটি বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা ব্যাপক বৃদ্ধি। এখন জোটের প্রতিটি সদস্য দেশকে এই পরিমাণ ব্যয় করতে হবে।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জুলি নরম্যানের মতে, এখন ‘আনপ্রেডিক্টেবিলিটি ডকট্রিন’ প্রয়োগ হচ্ছে। তিনি যুক্তি দেন, ‘আজকের পর কাল কী আসছে, তা জানা খুব কঠিন। আর এটি সব সময়ই ট্রাম্পের কৌশল ছিল।’

ট্রাম্প তার অস্থির স্বভাবের খ্যাতিকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে আটলান্টিকের দুই পারের প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে বদলে দিয়েছেন। আর দৃশ্যত ট্রাম্পকে নিজেদের পক্ষে রাখতে কিছু ইউরোপীয় নেতা তার তোষামোদ ও চাটুকারিতা করেছেন।

নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে গত মাসে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলন ছিল অতিশয় তোষামোদপূর্ণ। সম্মেলন শুরুর আগে ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুত্তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘প্রিয় ডোনাল্ড’ সম্বোধন করে একটি খুদেবার্তা পাঠিয়েছিলেন, যা ট্রাম্প ফাঁস করে দেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘ইরানের বিরুদ্ধে আপনার দৃঢ় পদক্ষেপের জন্য অভিনন্দন ও ধন্যবাদ, এটি সত্যিই অসাধারণ ছিল।’

এখন প্রশ্ন আসে ‘আনপ্রেডিক্টেবিলিটি ডকট্রিন’ বা ‘ম্যাডম্যান তত্ত্ব’ প্রতিপক্ষের ওপর কাজ করে কি না।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মতো একজন মিত্রকে ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স তিরস্কার করেছিলেন। পরে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রকে লোভনীয় সুবিধা দিতে সম্মত হন জেলেনস্কি।

অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ট্রাম্পের মুগ্ধতা ও হুমকি উভয় ক্ষেত্রেই নির্বিকার রয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার ফোনালাপের পর ট্রাম্প বলেন, পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করতে প্রস্তুত না থাকায় তিনি ‘হতাশ’।

তবে ‍ট্রাম্পের এমন আচরণ হিতে বিপরীতও হতে পারে। কারণ, দিনের পর দিন এমন আচরণ ট্রাম্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করবে। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা আলোচনায় বিশ্ব তার ওপর আস্থা রাখতে পারবে না। ‍চুক্তির পরও ট্রাম্প তা ভঙ্গ করবেন কি না তা নিয়ে প্রতিপক্ষের সংশয় থাকতে পারে। এতে নিশ্চিত কোনো মীমাংসাও ভেস্তে যেতে পারে।

অধ্যাপক নরম্যান বলেন, ‘যদি মানুষ আলোচনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস না করে, যদি তারা প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে থাকবে কি না সে বিষয় নিশ্চিত না হয়, তাহলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকতে চাইবে না। ফলে মাগা (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) সমর্থকদের অনেকেই যে একলা চলো নীতি চাইছে, আমার মনে হয় তা উল্টো ফল বয়ে আনবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধারই জাতির একমাত্র লক্ষ্য : গয়েশ্বর

ঘুষি মেরে বিমানের মনিটর ভেঙে ফেললেন লন্ডন প্রবাসী

ইসরায়েলের যে কারাগারে বন্দি শহিদুল আলম

আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান, টিটিপি প্রধান নিহতের গুঞ্জন

বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল কাবুল

এককভাবে সরকার গঠন করবে বিএনপি : এমরান চৌধুরী

‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে রংপুর অচল করে দিতে বাধ্য হবো’

নির্বাচন নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র সহ্য করা হবে না : লায়ন ফারুক

ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের পা বিচ্ছিন্ন

বৃহত্তর মিরপুরে সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত

১০

দেশ বাঁচাতে হলে বিএনপির বিকল্প নেই : টুকু

১১

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা / বস্তিবাসী ও শহীদ পরিবারের ন্যায্য দাবি মেনে নিন

১২

মা-মেয়েকে গলা কেটে হত্যা

১৩

রাজধানীতে ১৭ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জাগপা ছাত্রলীগের বৈঠক

১৪

হাত-মুখ বেঁধে শিশুকে ধর্ষণ, যুবককে খুঁজছে পুলিশ

১৫

এনসিটিবির নামে ‘নকল’ ছাপাখানা, আটক ৫ 

১৬

পচা চাল ক্রয়, বাচ্চু মিয়াকে বাধ্যতামূলক অবসর

১৭

শহিদুল আলমসহ নৌবহর থেকে আটক ব্যক্তিদের কারাগারে বন্দি

১৮

পা হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন আইসক্রিম বিক্রেতা রফিকুল

১৯

গুণগত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা তারেক রহমানের অঙ্গীকার : সাঈদ

২০
X