বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক খাত হলো তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইলশিল্প। এ খাতে দক্ষ মানবসম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা, প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং সৃজনশীল দক্ষতা। এই প্রেক্ষাপটে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি) একটি নির্ভরযোগ্য, আদর্শ এবং যুগোপযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যারা টেক্সটাইল, ফ্যাশন, অ্যাপারেল বা বিজনেস খাতে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী, তাদের জন্য বিইউএফটি একটি চমৎকার পছন্দ।
ঐতিহ্য ও প্রাতিষ্ঠানিক বিবর্তন
বিইউএফটি ১৯৯৯ সালে বিজিএমইএ ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিআইএফটি) হিসেবে যাত্রা শুরু করে। মূল লক্ষ্য ছিল দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে দক্ষ পেশাজীবী তৈরি করা। ২০১২ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অনুমোদন পায় এবং বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি নামে যাত্রা শুরু করে। সেই থেকে বিইউএফটি শিক্ষার মান, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং শিল্প-সংযোগের মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে নিজের অবস্থান শক্ত করেছে।
বৈচিত্র্যময় একাডেমিক প্রোগ্রাম
বিইউএফটি এমন সব প্রোগ্রাম অফার করে যা সরাসরি শিল্পের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর একাডেমিক কারিকুলাম প্রায়োগিক শিক্ষার উপর ভিত্তি করে গঠিত, যার ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে দ্রুত কর্মক্ষেত্রে নিজেদের মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিম্নলিখিত বিভাগসমূহে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম চালু করেছে :
• টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং • নিটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং • অ্যাপারেল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড টেকনোলজি • অ্যাপারেল মার্চেন্ডাইজিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট • ফ্যাশন ডিজাইন অ্যান্ড টেকনোলজি • ফ্যাশন স্টাডিজ • টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট • ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং • কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং • বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন • পরিবেশ বিজ্ঞান • ইংরেজি
এই প্রোগ্রামগুলো ছাড়াও বিইউএফটি অ্যাপারেল, নিট, সোয়েটার ও ওভেন মার্চেন্ডাইজিং-এ সংক্ষিপ্ত মেয়াদি সার্টিফিকেট কোর্স অফার করে, যা চাকরি বাজারে শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান গড়ে তোলে।
অত্যাধুনিক অবকাঠামো ও প্রযুক্তি
বিইউএফটি-এর স্থায়ী ক্যাম্পাস রাজধানী ঢাকার উত্তরা এলাকায় অবস্থিত, যার পরিসর ৬ একর। এখানে রয়েছে ১০ তলা বিশিষ্ট আধুনিক একাডেমিক ভবন, যার মোট ফ্লোর স্পেস ৫ লক্ষ বর্গফুট। এই ক্যাম্পাসে রয়েছে :
• ৭২টি আধুনিক ক্লাসরুম (মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, সাউন্ড সিস্টেম ও সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনিংসহ) • ৫৩টি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি (নিটিং, ডাইং, প্রিন্টিং, ফ্যাশন ডিজাইন, গারমেন্ট প্রোডাকশন ইত্যাদি) • সিএডি স্টুডিও : বিশ্বমানের সফটওয়্যার যেমন লেক্ট্রা ও গারবার ব্যবহৃত হয় • ফ্যাব্রিক ও গার্মেন্ট টেস্টিং ল্যাব • ফ্যাশন ফটোগ্রাফি ও প্রোডাকশন স্টুডিও • ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব, আইটি ল্যাব, ডিজাইন ল্যাব • অ্যাম্ফিথিয়েটার, আধুনিক অডিটোরিয়াম, সুইমিং পুল, ইনডোর-আউটডোর গেমস ফ্যাসিলিটি • সম্পূর্ণ ওয়াই-ফাই সক্ষম ক্যাম্পাস
এই অবকাঠামোগত সুবিধাগুলো একটি অনন্য শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা এবং গবেষণার সমন্বয়ে উন্নত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। শিল্প-সংযোগ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা
বিইউএফটির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর শিল্প-সংযোগ। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পায় বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি ভিজিট, ইন্টার্নশিপ, প্র্যাকটিক্যাল প্রজেক্ট, এবং সরাসরি ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টদের সেমিনারের মাধ্যমে। ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার শুরু থেকেই চাকরি প্রস্তুতির দিক দিয়ে এগিয়ে থাকে। পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও বিইউএফটি-এর কার্যকর অংশীদারিত্ব রয়েছে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্কলারশিপসহ উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম
বিইউএফটি বিশ্বের ৩২টি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে রয়েছে : অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, চেক প্রজাতন্ত্র, ভারত এবং মালয়েশিয়া। এই সহযোগিতার ফলে শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়াশোনা, যৌথ গবেষণা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। অনেক ক্ষেত্রে তারা পূর্ণ স্কলারশিপ এবং টিউশন ফি ছাড়ের সুবিধাও পেয়ে থাকে।
গবেষণা ও উদ্ভাবনে মনোযোগ
বিইউএফটি গবেষণাভিত্তিক শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ডেলফি, নুফিক নিচ, স্মার্ট ২০২০, এবং স্টেপ আপ+ প্রজেক্টের মতো আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পে অংশ নিয়েছে। এছাড়াও এটি নিম্নলিখিত আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য :
• ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফ্যাশন টেকনোলজি ইনস্টিটিউটস (আইএফএফটিআই) • দ্য টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট (যুক্তরাজ্য) • সোসাইটি অব ডাইয়ার্স অ্যান্ড কালারিস্টস (এসডিসি) • অ্যাসোসিয়েশন অব কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজ (এসিইউ)
এসব সদস্যপদ বিইউএফটি শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক গবেষণা নেটওয়ার্কে যুক্ত করে এবং জ্ঞান ও দক্ষতার পরিধি বাড়িয়ে তোলে।
সহশিক্ষা কার্যক্রম ও ব্যক্তিত্ব গঠন
শিক্ষার পাশাপাশি বিইউএফটি শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে। এখানে রয়েছে ২২টি স্টুডেন্ট ক্লাব, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব, যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক সচেতনতা, এবং সৃজনশীলতাসহ নানা দক্ষতা অর্জন করতে পারে। ক্লাবগুলো হলো :
• বিইউএফটি অ্যাপারেল ক্লাব • বিইউএফটি বিজনেস ক্লাব • বিইউএফটি ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট ক্লাব • বিইউএফটি চাইনিজ ভাষা ক্লাব • বিইউএফটি কম্পিউটার ক্লাব • বিইউএফটি সাংস্কৃতিক ক্লাব • বিইউএফটি বিতর্ক ও জনসম্মুখে বক্তব্য ক্লাব • বিইউএফটি ইংরেজি ভাষা ক্লাব • বিইউএফটি ফ্যাশন ক্লাব • বিইউএফটি চলচ্চিত্র, ফটোগ্রাফি ও মিডিয়া ক্লাব • বিইউএফটি গেমস ও স্পোর্টস ক্লাব • বিইউএফটি ঐতিহ্য ক্লাব • বিইউএফটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাব • বিইউএফটি নিটওয়্যার ক্লাব • বিইউএফটি লিও ক্লাব • বিইউএফটি মার্চেন্ডাইজিং ক্লাব • বিইউএফটি মডেল ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশন • বিইউএফটি রোভার স্কাউট গ্রুপ • বিইউএফটি বিজ্ঞান ও পরিবেশ ক্লাব • বিইউএফটি সামাজিক কল্যাণ ক্লাব • বিইউএফটি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট ও উদ্ভাবন ক্লাব • বিইউএফটি টেক্সটাইল ক্লাব
এই ক্লাবগুলোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত আয়োজিত হয় বিভাগীয় টুর্নামেন্ট, কালচারাল ফেস্ট, ফ্যাশন শো এবং ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম।
স্কলারশিপ ও আর্থিক সহায়তা
শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যা যাতে উচ্চশিক্ষার পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, সে লক্ষ্যে বিইউএফটি ১৬ ধরনের স্কলারশিপ ও ফি ছাড়ের সুবিধা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য :
• মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১০০% ফি ছাড় • মেধাভিত্তিক ফি ছাড় • বিশেষ বিভাগ যেমন ইংরেজি, এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্য বিশেষ সহায়তা • আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনভিত্তিক সহায়তা
এই সুযোগগুলো উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে এবং সমাজের নানা স্তরের শিক্ষার্থীকে সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে।
অনলাইন শিক্ষা ও প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা
কোভিড-১৯ মহামারীর সময় বিইউএফটি ছিল দেশের অন্যতম দ্রুততম প্রযুক্তি-উপযোগী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ রিসার্চ এডুকেশন অ্যান্ড নেটওয়ার্ক (বিডিরেন) কর্তৃক স্বীকৃতভাবে, বিইউএফটি সফলভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সম্পূর্ণ একাডেমিক কার্যক্রম স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়। এতে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে, যা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সাফল্য
বিইউএফটি-এর প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বর্তমানে দেশ-বিদেশে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে কর্মরত রয়েছেন। কেউ কেউ উদ্যোক্তা হিসেবে নিজস্ব ফ্যাশন ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন, আবার কেউ কেউ আন্তর্জাতিক গার্মেন্ট কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন। সদরুজ্জামান রাসেল, তৌহিদ বিন আবদুস সালাম, স্বপ্না ভৌমিক, ওয়াহিদ আসলাম রনি, নওরিন খানডকারের মতো ব্যক্তিত্বগণ এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক শিক্ষার্থী। তাদের মতো মানুষদের পথ অনুসরণ করাই শিক্ষার্থীদের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা। তাদের সাফল্য বিইউএফটির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মানের একটি জীবন্ত প্রমাণ।
টেকসই উন্নয়ন ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
পরিবেশ-সচেতনতা ও টেকসই উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে বিইউএফটি পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যক্রম চালু করেছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টি বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্বমূলক প্রকল্প যেমন ব্লাড ডোনেশন, দরিদ্রদের জন্য কম্বল বিতরণ, বস্তি উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনা করে থাকে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা ও সহানুভূতির গুণাবলি গড়ে ওঠে।
প্রাণবন্ত ও সংস্কৃতিময় ক্যাম্পাস জীবন
বিইউএফটি ক্যাম্পাস শুধু একটি শিক্ষা কেন্দ্র নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক অভিজ্ঞতার কেন্দ্রও বটে। তুরাগ নদীর পাশে অবস্থিত এই ক্যাম্পাস সবুজ পরিবেশে ঘেরা, যেখানে রয়েছে টেরাকোটায় তৈরি বাংলার ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ এবং টেক্সটাইল শিল্পের প্রতিচ্ছবি। ক্যাফেটেরিয়া, হেলথ সেন্টার, গেস্ট হাউস, সুটুডেন্ট কমন রুম, এবং রেস্ট এরিয়া-সব মিলিয়ে এখানে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সমন্বিত শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়।
উপসংহার
বিইউএফটি কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটি বাংলাদেশের টেক্সটাইল, অ্যাপারেল ও ফ্যাশন শিল্পে নেতৃত্বদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান। এর বৈচিত্র্যময় ও প্রাসঙ্গিক কারিকুলাম, শক্তিশালী ইন্ডাস্ট্রি সংযোগ, আধুনিক অবকাঠামো, আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব এবং গবেষণা ও সামাজিক উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতি বিইউএফটি-কে করে তুলেছে অনন্য। যারা একটি সফল ক্যারিয়ার গড়তে চান এবং ভবিষ্যতে গ্লোবাল ফ্যাশন ও টেক্সটাইল খাতে অবদান রাখতে চান তাদের জন্য বিইউএফটি নিঃসন্দেহে সঠিক সিদ্ধান্ত।
মন্তব্য করুন