সাড়ে ৮ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার শ্রীকর্ণদীঘি উচ্চবিদ্যালয়ে পিয়ন পদে চাকরি নিয়েছিলেন মাসুদ রানা। যোগদানের দেড় বছরে নিয়োগসংক্রান্ত জটিলতায় আজও তার বেতন ভাতা হয়নি। অবশেষ ঘুষের টাকা ফেরতের দাবিতে তিলকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য সাইফুল ইসলামকে আটক রেখে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়।
এদিকে পুলিশের উপস্থিতিতে দুপক্ষের দেন-দরবারে স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা লিখে নেওয়ার পর সাইফুল ইসলামকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গত রোববার (১৩ জুলাই) রাতে এই ঘটনাটি ঘটেছে।
ভুক্তভোগী পিয়ন মাসুদ রানার বাড়ি উপজেলার ঘোলকুড়ি গ্রামে ও ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলামের বাড়ি পাশের মোহনপুর গ্রামে। তিনি তিলকপুর ইউপির সাবেক সদস্য ও আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন নেতা ছিলেন।
পিয়ন মাসুদ রানা বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। জমি ও গরু বিক্রি করে সাড়ে ৮ লাখ টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছি। নিয়োগ বোর্ডের কারণে চাকরিতে যোগদানের দেড় বছরেও এমপিওভুক্ত হয়নি।’ ওই নিয়োগ বোর্ডে কখনও আমার এমপিওভুক্ত হবে না। নিয়োগ পরীক্ষার ২৫ দিন আগে ইউপির সাবেক সদস্য সাইফুল ইসলাম আমাকে তার বাড়িতে ডেকে নেন। সেখানে সেই সময়কার বিদ্যালয়ের সভাপতি মাজেদুল রহমানের উপস্থিতি সাড়ে ৬ লাখ টাকা সাইফুলের হাতে দিয়েছে। এরপর তিলকপুর বাজারের একটি স্থানে সভাপতি মাজেদুল রহমান ও সাইফুল আমাকে ডেকে নিয়ে সেখানে আরও দুই লাখ টাকা নিয়েছেন। ওই নিয়োগ বোর্ড বিধিসম্মত না হওয়ায় একাধিকবার অনলাইনে আবেদন করেও এমপিওভুক্ত হয়নি। সাইফুলের কাছে ঘুষের সাড়ে ৮ লাখ টাকা চাইলে নানান টালবাহনা শুরু করে। এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, একাডেমিক সুপারভাইজারকে জানিয়েছি। তারা কোনো পদক্ষেপ নেননি।
তিনি বলেন, রোববার রাতে সাইফুল মোটরসাইকেল নিয়ে শ্রীকর্ণদীঘি মোড়ের দোকানে ওষুধ কিনতে আসেন। আমরা তখন সাইফুলকে ধরে এনে একটি দোকানে বসে রেখে ঘুষের সাড়ে ৮ লাখ টাকা ফেরত চাই। সাইফুল প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। এই ঘুষের টাকা বিদ্যালয়ের সভাপতি মাজেদুল ইসলাম, প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন ও সাইফুল ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, পুলিশের উপস্থিতিতে স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা লিখে নেওয়ার পর তাকে রাত ১২টার দিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশ সাইফুলকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে।
এদিকে সরিজমিনে সোমবার (১৪ জুলাই) দুপুরে গিয়ে সাইফুল ইসলামকে তার বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইলও বন্ধ রয়েছে। তবে সাইফুলের স্ত্রী তাহমিদা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীর মধ্যস্থতায় বিদ্যালয়ের সভাপতি মাজেদুল ইসলাম টাকা নিয়েছেন। অথচ তারা আমার স্বামীকে রাতে আটকে রেখে মারধর করে তার কাছে স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা লিখে নিয়েছে।’
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের সভাপতি মাজেদুল ইসলাম বলেন, আমি বিএনপি করতাম। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে স্থানীয় এমপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বিদ্যালয়ের সভাপতি হয়েছি। একইসঙ্গে বিদ্যালয়ে তিনটা নিয়োগ দিয়েছি। আমি একটি টাকাও হাত ছুঁয়ে দেখিনি। বিধি সম্মতভাবে নিয়োগ বোর্ড হয়নি। এ কারণে বিদ্যালয়ের নতুন নিয়োগকৃত তিন কর্মচারীর কারও এমপিওভুক্ত হয়নি।
তিনি বলেন, সাইফুল আমাকে পিয়ন মাসুদ রানার নিয়োগে কোনো টাকা দেননি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন একদিন আমাকে সঙ্গে নিয়ে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে গিয়ে সেখানকার নতুন কর্মচারীদের নিয়োগসংক্রান্ত ব্যাপারে ওই অফিসের কর্মচারী আব্দুর রাজ্জাক আকন্দ দুলালকে দুই লাখ টাকা দিয়েছিলেন। এই দুই লাখ টাকা কোথায় পেলেন প্রধান শিক্ষক এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেটা আমি জানি না।’
প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন বলেন, আমি নিয়োগ বাণিজ্যে সম্পর্কে কিছুই জানি না। তখন আওয়ামী লীগের নেতারা ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মাজেদুল ইসলাম আমাকে কোণঠাসা করে বিদ্যালয়ে তিনটি নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমি শুধু সভাপতিকে সঙ্গে নিয়ে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কর্মচারীকে দুই লাখ টাকা দিয়েছি। নিয়োগ বোর্ডের জন্য এই টাকা দিতে হয়। সেই সময় নিয়োগ বোর্ড বিধি সম্মত হয়নি। এ কারণে তিন কর্মচারী এমপিওভুক্ত হয়নি। সেই তিনটি পদে আবার নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
আব্দুর রাজ্জাক আকন্দ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কার্যালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে চাকরি করেন। তার গ্রামের বাড়ি রায়কালী ইউনিয়নের পুন্ডিয়া গ্রামে। তিনি শ্রীকর্ণদীঘি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে দুই লাখ টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে কেউ টাকা দেয়নি।’
এ বিষয়ে আক্কেলপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন বলেন, শ্রীকর্ণদীঘি উচ্চবিদ্যালয়ে পিয়ন মাসুদ রানার কাছে সাড়ে ৮ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছিল। পরে নিয়োগ দিলেও বৈধ হয়নি। ঘুষের টাকা ফেরতে লোকজন সাবেক মেম্বরকে আটকে রেখেছিল। আমরা জরুরি সেবা ৯৯৯-এ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ঘুষের টাকা ফেরত দেবে স্ট্যাম্পে লিখিত অঙ্গীকারনামা করা হয়। এরপর লোকজন সাবেক মেম্বার সাইফুলকে ছেড়ে দিয়েছেন।
মন্তব্য করুন