সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিলে দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন করে কারফিউ জারি করে সরকার। পাশাপাশি গত ১৬ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাত ৮টার দিকে সবধরনের ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। এতে বড় ধরনের বিপাকে পড়েন ব্যাংক গ্রাহকরা। একই সঙ্গে কারফিউ ও সহিংসতার কারণে দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলে সাধারণ ছুটি। এ সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ, ক্রেডিট কার্ডের ঋণ বা অন্যান্য বিল পরিশোধে বিলম্ব ফি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাথমিকভাবে ব্র্যাক, সিটি ও ইস্টার্ন ব্যাংক গ্রাহকদের বিলম্ব ফি ও সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ খরচের ৪৫ দিনের মধ্যে সেটি পরিশোধ করতে হয়। অন্যথায় ঋণের ওপর দিতে হয় সুদ। কিন্তু কোটা আন্দোলন, কারফিউ ও সাধারণ ছুটিতে ব্যাংক বন্ধ থাকায় ক্রেডিট কার্ডের ঋণের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও অর্থ পরিশোধ করতে পারেননি অনেক গ্রাহক। পাশাপাশি ঋণের কিস্তি এবং ব্যাংকের অন্যান্য বিলও পরিশোধ করা যায়নি। দেশে কারফিউ ও সাধারণ ছুটির কারণে যেসব গ্রাহক ব্যাংক ঋণ, ক্রেডিট কার্ডের ধার ও ব্যাংকের অন্যান্য বিল পরিশোধ করতে পারেননি, তাদের বিলম্ব ফি ছাড় দেওয়ার চিন্তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
এরই মধ্যে নিজস্ব উদ্যোগে বেসরকারি খাতের ব্র্যাক, সিটি ও ইস্টার্ন ব্যাংক গ্রাহকদের থেকে বিলম্ব বিল ও সুদ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোনো গ্রাহক ব্যাংক লেনদেন স্বাভাবিক হওয়ার পর বিল পরিশোধে বিলম্ব করলে তিনি এই সুবিধার আওতার বাইরে থাকবেন।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি সেলিম আর এফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, সহিংসতা, কারফিউ ও সাধারণ ছুটির কারণে গত কয়েকদিন থেকে ব্যাংক বন্ধ। ইন্টারনেটও বন্ধ। এ অবস্থায় আমরাই প্রথম ব্যাংক হিসেবে বিলম্বিত ফি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গভর্নর বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। অন্য ব্যাংকগুলোও গ্রাহকদের কথা বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন কালবেলাকে বলেন, দেশে কারফিউ, সাধারণ ছুটি ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অনেক গ্রাহক ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক ঋণ ও অন্যান্য বিল পরিশোধ করতে পারেননি। এটি একটি রাষ্ট্রীয় সমস্যা ছিল। তাই আমরা বিলম্ব ফি ও সুদ মওকুফ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যতদিন ব্যাংক ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকবে গ্রাহকরা ততদিন এই সুবিধা পাবেন। ব্যাংক খোলার পর আমরা হিসাব করে গ্রাহকদের এই বিলম্ব ফি ও সুদ ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেবে কি না, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এটা ব্র্যাক ব্যাংকের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে ব্যাংক খোলার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক আলোচনার মাধ্যমে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কি না, সে বিষয়টি দেখা হবে।
গত ১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহারকারীরা লেনদেন নিয়ে পড়েছেন ঝামেলায়। এমনকি ইন্টারনেটভিত্তিক এমটিএম সিআরএমগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আগের প্রযুক্তিতে যুক্ত কয়েকটি এটিএম থেকে টাকা তোলা যাচ্ছে। তবে এটিএমগুলোতে ঠিকমতো টাকা লোড না হওয়ায় তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশের ৩৯ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড সেবা দিচ্ছে। জানুয়ারি শেষে এসব ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ ৩০ হাজার। ২০১৯ সালের জানুয়ারি শেষে এ কার্ডের সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ১৩ হাজার। অর্থাৎ মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে ক্রেডিট কার্ড বেড়েছে ১১ লাখ ১৭ হাজার বা ৮৫ শতাংশ। একই সময়ে লেনদেনের পরিমাণও বেড়েছে। জানুয়ারিতে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে লেনদেন হয় ১ হাজার ১১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৫ বছরের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ১৬০ দশমিক ৮২ শতাংশ।
এ ছাড়া বর্তমানে দেশের ৬১ ব্যাংকে ১৫ কোটি ৩৫ লাখ ৬১ হাজার হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবে আমানত রয়েছে ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। আর ১ কোটি ৩০ লাখ ২৮ হাজার ২৭৮টি ঋণ হিসাবে ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৩৪২ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এসব ঋণ পরিশোধের মেয়াদ গত কয়েকদিনের মধ্যে থেকে থাকলে তবেই সুবিধাভোগী হবেন গ্রাহক।