বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) হলো সরকারি তথ্যের একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। অথচ এই প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানের তথ্যের গুণগতমান নিয়ে ব্যবহারকারীদের অর্ধেকেরও বেশি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। এ ছাড়া বিবিএসের তথ্যের সময়োপযোগিতা নিয়েও অসন্তুষ্ট উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যবহারকারী। তথ্যের সঠিকতা নিয়েও অসন্তুষ্ট এক-চতুর্থাংশ ব্যবহারকারী। বিবিএসের পরিসংখ্যান সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্টি জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিএসের তথ্য ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্টির ওপর ‘ইউজার স্যাটিসফেকশন সার্ভে-২০২৪’ শীর্ষক জরিপ করেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। গতকাল বৃহস্পতিবার বিবিএসের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত ও প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যান সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্টি ও চাহিদার মাত্রা নিরূপণের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো এ জরিপ পরিচালনা করা হয়।
এ জরিপে মোট নমুনার আকার হলো ১ হাজার ৩৩৩। এর মধ্যে ২২ দশমিক ২৮ শতাংশ মহিলা উত্তরদাতা। বেশিরভাগ উত্তরদাতার বয়স ২৮ থেকে ৫৫-এর মধ্যে এবং গড় বয়স হলো ৪৫। সবচেয়ে সিনিয়র উত্তরদাতারা ৮৮, সবচেয়ে কম বয়সী ২১ বছর। তাদের গড় কাজের অভিজ্ঞতা ১৭ বছর।
বিআইডিএসের ইউজার স্যাটিসফেকশন সার্ভে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিবিএসের মাধ্যমে প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যানের তথ্যে সন্তুষ্ট ২৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ ব্যবহারকারী। পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয় ৫৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ আর কিছুটা অসন্তুষ্ট ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অন্যদিকে বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যে পুরোপুরি অসন্তুষ্ট ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ ব্যবহারকারী।
জরিপের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গুণগত মানের দিকে থেকে পণ্যমূল্য এবং শ্রম পরিসংখ্যান নিয়ে সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে ব্যবহারকারী। তথ্য অনুযায়ী, পণ্যমূল্যের পরিসংখ্যানে সন্তুষ্টি মাত্র ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, আর পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয় ৬০ দশমিক ১০ শতাংশ। অন্যদিকে শ্রম পরিসংখ্যানে সন্তুষ্ট ২৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন ৫৭ দশমিক ১৯ শতাংশ। এই দুই পরিসংখ্যানে ২০২২ সালের তুলনায় ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্টি কমেছে।
বিবিএস প্রকাশিত বিভিন্ন জরিপ ও শুমারির গ্রহণযোগ্যতা ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেড়েছে। তবে এখনো একটি পক্ষ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পরিসংখ্যানের নির্ভুলতা নিয়ে অসন্তুষ্ট। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বিবিএসের অফিসিয়াল পরিসংখ্যানের সঠিকতা নিয়ে ৬৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ ব্যবহারকারী সন্তুষ্ট। আর ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ব্যবহারকারী অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে ১০ শতাংশেরও বেশি ব্যবহারকারীর তথ্যে সঠিকতা জানা যায় না। তথ্যের সঠিকতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার পরিসংখ্যানে সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন ব্যবহারকারীরা।
সবচেয়ে বেশি তথ্যের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সন্তুষ্ট ব্যবহারকারী। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, বিবিএসের পরিসংখ্যানের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সন্তুষ্ট ৭৭ দশমিক ০৬ শতাংশ ব্যবহারকারী। অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে ১৭ শতাংশ ব্যবহারকারী। পরিসংখ্যানের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে ধারণা নেই ৬ শতাংশ ব্যবহারকারীর।
অন্যদিকে, বিবিএসের পরিসংখ্যানের সময়োপযোগিতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট ব্যবহারকারীরা। জরিপ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিবিএসের পরিসংখ্যানের সময়োপযোগিতা নিয়ে সন্তুষ্ট ৫৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ আর অসন্তুষ্ট ৩৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ ব্যবহারকারী। ৭ শতাংশের বেশি ব্যবহারকারীদের এ বিষয়ে ধারণা নেই। বিশ্লেষকদের মতে, কত মানুষ এখানে অংশগ্রহণ করেছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসম্মত তথ্য প্রকাশ করা। এজন্য তথ্যকে আরও ভেঙে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পরিবেশন করতে হবে। তাহলে মান বাড়বে। তাদের মতে, পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করে। কিন্তু বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যের গ্রহণযোগ্যতো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই বিবিএসের উচিত মানোন্নয়ন নিয়ে কাজ করা। বিষয়টিকে খুবই দুঃখজনক উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল দায়িত্বে থাকাকালীন পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ডাটা ডক্টরিংয়ের সেন্টারে পরিণত করেছিলেন। এখানে মোট জিডিপির মোট জনসংখ্যাসহ সব তথ্যে গরমিল করেছে। মাথাপিছু জিডিপিকে বাড়ানোর উদ্দেশ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে এবং মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে। এতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে এই গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।
পরিসংখ্যানের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি শিক্ষায়: জরিপের ফলে দেখা যায়, বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত ডোমেনের মধ্যে, শিক্ষার পরিসংখ্যান সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ৭৩ দশমিক ২১ শতাংশ ব্যবহারকারী এই ডেটার সঙ্গে জড়িত। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তথ্য ব্যবহার হয় জনসংখ্যা, এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান (৭২ দশমিক ১০ শতাংশ), এবং আয় এবং দারিদ্র্য পরিসংখ্যান (৬৮ দশমিক ৫২ শতাংশ) তৃতীয় সর্বোচ্চ।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৬৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ তথ্য ব্যবহারকারী জনসংখ্যা, জনসংখ্যাগত এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান বেশি ঘন ঘন ব্যবহার করে। তথ্য সংগ্রহের দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে আয় এবং দারিদ্র্য পরিসংখ্যান (৬০ দশমিক ৭৭ শতাংশ) এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় জাতীয় অ্যাকাউন্ট পরিসংখ্যান (৫৪ দশমিক ৯১ শতাংশ)। সবচেয়ে কম ব্যবহার হয় অপরাধ ও বিচার বিভাগীয় পরিসংখ্যান (৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার (১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ)।
এসব তথ্য সংগ্রহের সিংহভাগই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নেয় ব্যবহারকারীরা। বিবিএস ওয়েবসাইট বা ডেটা পোর্টালে গিয়ে ৮৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ তথ্য সংগ্রহ করেছে, যেখানে ৪৮ দশমিক ১৬ শতাংশ এটি প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে পেয়েছে। ৪১ দশমিক ২৬ শতাংশ বিনামূল্যে পেয়েছে।