মৃত্তিকা সাহা
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০৩:০৫ এএম
আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:৫৪ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ওষুধে পারলেও অক্ষম চিকিৎসা সরঞ্জামে

ওষুধে পারলেও অক্ষম চিকিৎসা সরঞ্জামে

নানা কারণে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় মানুষ অসুস্থ হচ্ছে বেশি। হাসপাতালের ধারণক্ষমতার চেয়ে রোগীর সংখ্যা আরও বেশি। আবার বিভিন্ন হাসপাতালের আউটডোর ও চিকিৎসকের চেম্বারে যাওয়া-আসা রোগীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সবখানেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওষুধের চেয়ে এসব রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন হয় রোগের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির। আর এখানেই দেশের সামগ্রিক চিকিৎসা খাতের বড় অক্ষমতা ফুটে উঠেছে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী বাজার মাত করছে দেশে উৎপাদিত ওষুধ। এখন পর্যন্ত ছোট-বড় ২৬৯টি কোম্পানির মাধ্যমে মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর বিশ্বের ১৪৮টি দেশে এই ওষুধ রপ্তানির মাধ্যমে প্রতিবছর আয় করছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। অথচ ওষুধেরই সহখাত চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি উৎপাদনের সক্ষমতা বিবেচনায় এখনো সেই শিশু অবস্থাতেই রয়ে গেছে দেশ। এখন পর্যন্ত এ খাতে আসেনি কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ। যতদূর জানা গেছে, মাত্র ১৫টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের কোম্পানি বিনিয়োগ আনলেও তাদের উৎপাদিত ও সরবরাহকৃত সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির গুণগত মান, গ্রহণযোগ্যতা এবং দাম এবং নিয়ে গ্রাহক তথা ব্যবহারকারীর মধ্যে রয়েছে বেশ আস্থার সংকট। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগও খুব একটা হচ্ছে না। আবার এ লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার এবং উদ্যোক্তা শ্রেণির মধ্যে আগ্রহও খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত বাজার চাহিদার মাত্র ৬ থেকে ৮ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়ে পূরণ করা যাচ্ছে। ফলে ডলার সংকটের মধ্যেও চাহিদার ৯২ থেকে ৯৪ শতাংশই আমদানি করতে হচ্ছে রিজার্ভ থেকে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে।

এদিকে দিন দিন মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়লেও অতিমাত্রার আমদানিনির্ভরতার কারণে সেই অনুযায়ী নিজস্বভাবে তৈরি করা চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জোগান মিলছে না। তদুপরি করোনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, নিউমোনিয়া, হেপাটাইটিস এ, টাইফয়েডসহ বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের পাশাপাশি অসংক্রামক রোগও অনেক বেড়েছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হৃদরোগ, স্ট্রোক, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার, কিডনি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুর হারও। এর ফলে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে এসব চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির চাহিদা এবং ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এতে প্রতিবছর বড় হচ্ছে এ খাতের বাজার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি হাসপাতাল আয়েশা মেমোরিয়ালের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম মূলত আমদানিনির্ভর। উৎপাদনও হচ্ছে কিছু। তবে সেগুলো খুব ছোট ছোট এবং স্বল্প পরিসরে। তদুপরি এর গ্রহণযোগ্যতাও সবার মধ্যে এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। দেশে মানসম্মত সরঞ্জাম তৈরিতে আরও সময় লাগবে বলে দাবি করেন তিনি।

তবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত সরঞ্জামের মান আন্তর্জাতিক মানের দাবি করছেন স্থানীয়ভাবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসের কোম্পানি সচিব বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ (ডব্লিউএইচও) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গাইডলাইন মেনে এবং বাংলাদেশে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনে সরঞ্জাম উৎপাদন ও বাজারজাত করা হয়। এখানে মানের সঙ্গে আপস করা যায় না। আর দাম খুব বেশি নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যূনতম লাভে সরঞ্জাম বাজারে ছাড়ে।

আমদানির চিত্র ও দেশীয় অংশীদারত্ব: বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে পাঁচ হাজারের বেশি চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহার হয়। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, রক্তের ব্যাগ, রক্ত সঞ্চালন সেট, ক্যানুলা, রক্ত সংগ্রহের টিউব, হাসপাতালের শয্যা, আইসিইউ শয্যাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উৎপাদন করা হয়। বিডার তথ্যানুযায়ী, দেশে ক্রমান্বয়ে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার বড় হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর বাজার ছিল ২৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছর এর বাজার দাঁড়ায় ৪১৬ মিলিয়ন ডলারের। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর দেশে এ খাতের আকার দাঁড়াবে ৮২২ মিলিয়ন ডলার বা ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকার।

দরকার নীতি সহায়তা: প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা এবং প্রযুক্তি ও গবেষণাগত সুবিধা পেলে আমদানিনির্ভর চিকিৎসা সরঞ্জাম খাত দেশেই ওষুধ শিল্পের মতো স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। অভ্যন্তরীণ বাজার চাহিদা মিটিয়ে তা বিদেশে রপ্তানিও করা যাবে। এমন মতামত দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ইতোমধ্যে গত এক দশকে দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরির স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বিকাশ হতে শুরু করেছে। বর্তমানে এ খাতে স্থানীয় উৎপাদকের সংখ্যা ১৫টিতে উন্নীত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান শতাধিক চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরি করছে। এদের সার্জিক্যাল ও ডায়াগনস্টিকের যন্ত্রপাতিও রয়েছে।

এ বিষয়ে আয়েশা মেমোরিয়ালের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী কালবেলাকে জানান, স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে হলে বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে। সেইসঙ্গে সরকারের বড় ধরনের নীতি সহায়তা লাগবে। এ বিষয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। তাই আমি আশাবাদী, কোনো এক সময় বাংলাদেশও চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরি করে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পরও বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে।

তিনি আরও দাবি করেন, দেশে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার খুব একটা বড় নয় যে, কেবল দেশের চাহিদা পূরণ করলেই বিনিয়োগকারীরা টিকে থাকবে। এজন্য অবশ্যই রপ্তানির দিকেও যেতে হবে। সেজন্য উৎপাদনে গুণগত মান এবং আস্থা অর্জনেও গুরুত্ব থাকা উচিত।

বড় বাধা বিনিয়োগ: স্থানীয় উৎপাদনের বড় বাধা হচ্ছে বিনিয়োগ। এ খাতে বড় বড় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে না এলে আমদানিমুখী বাজার থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না। এ খাতে উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করে তুলতে সরকার কী করছে? তার উত্তর জানা যায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. ইউসুফের বক্তব্যে। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে তিনি জানান, আমদানির বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কারণে ব্যাপক অর্থ খরচ করেও অনেক সরঞ্জাম প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে পাওয়া যায় না। সেজন্য আমরা এসব সরঞ্জামের দেশেই উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছি বলে দাবি করেন তিনি। এই মহাপরিচালক আরও বলেন, এজন্য উদ্যোক্তা, আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানিয়েছি। বিশেষজ্ঞদেরও বলেছি। যারা এসব সামগ্রী ব্যবহার করে তাদের চাহিদা জানার জন্য। কীভাবে এসব যন্ত্রপাতির উৎপাদন বাড়াতে পারি, সেই চেষ্টা করছি। দেশে সবকিছুই উৎপাদন সম্ভব। আমরা টেকনিক্যালি অনেক অগ্রসর। এখন সরকার যাতে কম মূল্যে উৎপাদকদের ভূমি (জমি) দেয়, সেই বিষয়েও কাজ করছি। আগামীতে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়বে এবং আমদানিনির্ভরতা অনেক কমবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এইডস রোগীদের বাঁচাতে টিকা আনছে রাশিয়া

বিদেশি শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের মার্কিন ভিসা নিয়ে দুঃসংবাদ

পরিচালক নয়, সভাপতি হয়েই বিসিবিতে ফিরতে চান তামিম

তিশাকে কোলে তুলতে গিয়ে হাত ভেঙেছিল: তৌসিফ মাহবুব

ডিআরইউতে লতিফ সিদ্দিকীসহ আ.লীগের নেতাকর্মী অবরুদ্ধ

আগারগাঁও মোড়ে শিক্ষার্থীদের ব্লকেড, যান চলাচল বন্ধ

আবাসিক হোটেল থেকে পুরুষ সঙ্গীসহ টিকটকার মাহি আটক

১২ ফুট লম্বা অজগর বস্তায় করে বাড়িতে নিয়ে গেল যুবক

কত সম্পদের মালিক টেইলর-কেলসে?

৪ কারণে ভেঙে দুই ভাগ হয়েছিল চট্টগ্রামের সেতুটি

১০

পুলিশের পোশাকে থানায় গুরুদায়িত্বে বিড়াল!

১১

নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের পরও দলকে জেতাতে পারলেন না সাকিব

১২

দলকে ফাইনালে তুলে যা বললেন মেসি

১৩

চাকরি দিচ্ছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, থাকছে না বয়সসীমা

১৪

আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ উত্তেজিত জনতার

১৫

আবু সাইদ হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ আজ

১৬

কেন নিজের ‘বিকিনি’ ছবির পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেন শর্মিলা?

১৭

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ৪ প্রতিনিধি যোগ দিলেন ছাত্রদলে

১৮

ধীরে ধীরে খেলে কি সত্যি ওজন কমে?

১৯

চীন সফরে কিম-পুতিনসহ ২৬ রাষ্ট্রপ্রধান

২০
X