বাড়িঘর ও আঙিনা থেকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় বন্যাকবলিত সিলেট শহরসহ ১৩টি উপজেলায় জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তবে বন্যাদুর্গতরা এখন ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিস, টাইফয়েড, চর্মরোগসহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কায় আছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সিলেট বিভাগের চার জেলায় গত আট দিনে ডায়রিয়া, আরটিআই, চোখের প্রদাহ, চর্মরোগসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৯ হাজার ৮২৬ জন। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিলেট বিভাগজুড়ে কাজ করছে স্বাস্থ্য বিভাগের ৩৯৪টি মেডিকেল টিম।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সোমবার পর্যন্ত সিলেটে ৮ লাখ ৩ হাজার ৩৬৫ মানুষ বন্যাকবলিত রয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট মহানগরে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ১৫ হাজার। বর্তমানে মহানগরের আটটি ওয়ার্ড ও জেলার ১১০টি ইউনিয়নে বন্যার পানি রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন ১৩ হাজার ২০৯ জন। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। তবে বেশিরভাগ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন।
সিলেটে বর্তমানে আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন ১৩ হাজার ২০৯ জন। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। পৌঁছানো হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধপত্র। জেলার দুটি উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাটের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, চলতি বন্যায় অসতর্কতায় নৌকা দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে গোয়াইনঘাটের ফতেহপুরে প্রাণ হারিয়েছেন ২৫ বছর বয়সী এক তরুণ। এ ছাড়া বন্যা ও বৃষ্টিকালীন বিছনাকান্দি এলাকায় বৈদ্যুতিক লাইন থেকে বিদ্যুৎস্পর্শে ১১ বছর বয়সী কন্যাশিশু এবং ২২ বছর বয়সী এক তরুণ মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি জানান, পানিবন্দি অবস্থায় পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি রয়েছে। এটা প্রশমনে ও নিয়ন্ত্রণে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের সহায়তায় স্থাপন করা হয়েছে ভ্রাম্যমাণ (মোবাইল) ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, যা দিয়ে গোয়াইনঘাটের বিভিন্ন ইউনিয়নে ২১ জুন থেকে প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, গোয়াইনঘাটে পানিবন্দি হাওর এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে কাজ করছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কিশলয় সাহা। বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। ৩ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণের সঙ্গে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট প্রতি পরিবারকে ১০টি করে দেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্যার পর বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। সাধারণত বন্যার পানি নেমে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। বন্যা-পরবর্তী রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় গোয়াইনঘাট উপজেলায় ১০টি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম কাজ করছে। প্রত্যন্ত হাওর এলাকায়ও মেডিকেল টিম স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক সুদিন চন্দ্র দাস বলেন, বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ ডায়রিয়া, জন্ডিস, চর্মরোগ, টাইফয়েডসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। আমরা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে প্রস্তুত।
চর্মরোগ বিভাগের বিভাগীয় সহকারী অধ্যাপক ডা. পরিমল কুমার সেন বলেন, বন্যার পানির মধ্য দিয়ে যাদের চলাচল করতে হয়েছে, তারা স্ক্যাবিস এবং কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিসসহ বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ওসমানী হাসপাতালে সেবা নেওয়ার অনুরোধ জানান।
গোয়াইনঘাট উপজেলার সুমা বেগম বলেন, প্রবল বর্ষণ ও বন্যার সময় চার দিনে ঠান্ডা লেগে অনেক শিশু ও বয়স্ক মানুষ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। অনেকেই চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কোম্পানীগঞ্জের হুছনা বেগম বলেন, ওই এলাকার অনেক মানুষ ডায়রিয়া, পেট ব্যথা ও চর্মরোগে ভুগছেন। বন্যাদুর্গত মানুষের চিকিৎসার জন্য এ পর্যন্ত এলাকায় সরকারিভাবে কোনো চিকিৎসা ক্যাম্প করা হয়নি বলে তিনি অভিযোগ করেন।
সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মজয় দত্ত বলেন, পানিবাহিত রোগের রোগী আছে, তবে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নয়। পানিবাহিত রোগ মোকাবিলায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। বন্যায় পানিবাহিত রোগ থেকে বাঁচার জন্য সবাইকে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আহ্বান করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট আমরা বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের ইউনিয়নভিত্তিক টিমও কাজ করছে।