সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম মাত্রায় এনে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। যেহেতু এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার জন্য ডাকা হয়নি, আবার ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে আপিল বিভাগ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় রাজপথেই দাবি আদায়ের চিন্তা আন্দোলনকারীদের। লাগাতার এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে এবার ৬৪ জেলায় অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। সকাল-সন্ধ্যা এই অবরোধের আওতায় থাকবে সড়ক ও রেলপথ।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ প্রমুখ। তারা বলছেন, দাবি আদায়ের আগ পর্যন্ত রাজপথে থাকব আমরা। সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে কমিশন গঠনের মাধ্যমে দাবি মেনে নেওয়া হলেই শুধু রাজপথ ছেড়ে ক্লাসরুমে ফিরে যাব।
এর আগে গত রবি ও সোমবার ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা লাগাতার আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন। রাজধানীর শাহবাগের পাশাপাশি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল মোড়, বাংলামটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, কাঁটাবন, সায়েন্সল্যাব, নীলক্ষেত, চানখাঁরপুল, গুলিস্তান জিরো পয়েন্টসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের চাকরিপ্রত্যাশী ও শিক্ষার্থীরা ঢাকামুখী সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। এতে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। গতকাল কেন্দ্রীয় কর্মসূচি না থাকলেও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ অনলাইন-অফলাইন গণসংযোগ চালান আন্দোলনকারীরা। তবে রাজধানীর বাইরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
কর্মসূচি ঘোষণা করে নাহিদ ইসলাম বলেন, সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে এনে সংসদে আইন পাস করার দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি। সেই ধারাবাহিকতায় আজ বুধবার সারা দেশে সকাল ১০টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ব্লকেড কর্মসূচি পালিত হবে। এ ব্লকেডের অন্তর্ভুক্ত হবে সড়ক ও রেলপথ। সারা দেশের প্রতিনিধিরা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো অবরোধ করবেন।
আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা কোটার বিরোধিতা করছি না। আমরা ন্যূনতম মাত্রায় কোটার পক্ষে আন্দোলন করছি। অনেকেই আমাদের আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কি না, তা নিয়ে আলোচনা করছেন। আমরা পরিষ্কার করে বলছি যে, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রাখি। কোটা কাদের জন্য হতে পারে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোটা প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য থাকতে পারে।
সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, একদফা দাবি দেশের নির্বাহী বিভাগের কাছে। সংসদে আইন পাস করে সরকারি চাকরির সব গ্রেডে সব ধরনের বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় রেখে কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। এ দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের কর্মসূচি চলবে।
এদিকে, কোটা ব্যবস্থা বহাল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে আবেদন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। আবেদনকারী ওই শিক্ষার্থীরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আল সাদী ভূঁইয়া এবং উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আহনাফ সাঈদ খান।
তারা জানিয়েছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নিজ উদ্যোগে তারা আবেদন করেছেন। চলমান আন্দোলনের পক্ষ থেকে নয়। তারা এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত নয় বলেও জানিয়েছেন। আবেদনের ওপর দুপুরে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের আদালতে শুনানি শেষে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠানো হয়। আজ প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এর শুনানি হওয়ার কথা। এর আগে গত ৪ জুলাই রিটকারী পক্ষের আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি মুলতবি করা হয়।
বুয়েট শিক্ষার্থীদের মৌন সমাবেশ: কোটার বিরুদ্ধে বেশকিছু দিন ধরে চলা আন্দোলনে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকলেও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। তবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে এবার তারা ক্যাম্পাসে মৌন সমাবেশ করেছেন। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় ১০ মিনিটের মতো বুয়েট শহীদ মিনারের সামনে এই মৌন সমাবেশের আয়োজন করেন তারা। এ সময় শিক্ষার্থীদের কেউ কোনো বক্তব্য দেননি এবং সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তবে তারা একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিজেদের দাবি জানিয়েছেন।
এতে বলা হয়, দেশের সর্বস্তরে কোটা সংস্কার বিষয়ক যেসব আন্দোলন হচ্ছে, তা অত্যন্ত যৌক্তিক। আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সর্বাত্মকভাবে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করছি। এ ছাড়া মেধার মূল্যায়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে অতি দ্রুত রায় প্রদান করার জন্য আদালতের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।