চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা ছোট্ট ছেলে ইউনূস। তরুণ বয়স থেকেই দারিদ্র্য বিমোচনের স্বপ্ন দেখতেন তিনি, স্বপ্ন দেখাতেন সাম্যবাদের। সেই স্বপ্নগুলো থেকেই চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জোবরা গ্রামে শুরু হয় নানা কার্যক্রম। এসব কার্যক্রমের প্রাতিষ্ঠানিক রূপই আজকের গ্রামীণ ব্যাংক। মূলত
ক্ষুদ্রঋণ নামে নতুন একটি ধারণা নিয়ে ১৯৮৩ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম নেয় গ্রামীণ ব্যাংক। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এটি প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামীণ জনপদের সেই ইউনূসকে ঘিরেই এখন বঞ্চনা মুক্তির স্বপ্ন দেখছেন সারা দেশের মানুষ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. ইউনূসকে ঘিরে সেই আশার আলো যেন দেখা গেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সবক্ষেত্রেই। আর জোবরা গ্রামে পথচলা শুরু করে ইউনূসই হয়ে ওঠেন জাতির কান্ডারি।
জানা গেছে ড. ইউনূসকে সবাই জোবরা গ্রামের সন্তান হিসেবে চিনলেও তিনি ১৯৪০ সালের ২৮ জুন জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর কাপ্তাই সড়কের বাথুয়া গ্রামে। তার পাশের গ্রামই জোবরা গ্রাম। জোবরা গ্রামেই বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেন ইউনূস। তাই অনেকেই মনে করেন, তিনি জোবরা গ্রামের সন্তান। পরিবারের নয় ভাইবোনের মধ্যে ইউনূস হলেন তৃতীয়। তার বাবা হাজি দুলা মিয়া সওদাগর ছিলেন একজন জহুরি এবং তার মা সুফিয়া খাতুন। তার শৈশব কাটে গ্রামে।
গ্রামীণ ব্যাংকের হাটহাজারী শাখার সাবেক এরিয়া ম্যানেজার জাকারিয়া হাবিব কালবেলাকে বলেন, আমার দায়িত্বকালীন (২০০৬ থেকে ১৪ সালে) দেখেছি, তিনি সবকিছু সরাসরি মনিটরিং করতেন। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদবিহীন ঋণের জন্য নার্সিং, শিক্ষাসহ গরিবদের সব সুযোগ-সুবিধা দিতেন তিনি। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অনেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য গেলেও গুরুত্ব দিতেন তিনি। এক কথায় মানবিক একজন মানুষ। সরকারের দায়িত্ব নিয়েও তিনি সফলতা এগিয়ে যাবেন বলে আমার বিশ্বাস।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বব্যাপী এত সম্মান, পুরস্কার ও গ্রহণযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিহিংসার কারণে তিনি অবহেলিত ছিলেন দেশে। বায়বীয় সব অভিযোগে
সময়ে-অসময়ে, কারণে-অকারণে তাকে নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে গেছে বিভিন্ন মহল। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক কেড়ে নিয়ে ব্যাংকের ভবন থেকে তার ছবি পর্যন্ত নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। অথচ এই ব্যাংকের সুউচ্চ ভবন তৈরি করিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। দেশে পদে পদে বাধা-বিপত্তির মুখে না পড়লে আরও আগেই দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারতেন বিশ্বনন্দিত এই ব্যক্তিত্ব।
কলামিস্ট মুহাম্মদ মুসা খান কালবেলাকে বলেন, ড. ইউনূসকে আমরা দেখেছি একজন সৎ ও দারিদ্র্য মানুষের আপনজন হিসেবে। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা সদস্যাদের সঙ্গে মাটিতে বিছানা পেতে তিনি বসে যেতেন। তাদের অভাবের কথা, দারিদ্র্যের কথা শুনতেন মন দিয়ে। তৎক্ষণাৎ যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন। কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। বদলি-পদোন্নতির জন্য কেউ তদবির করতে পারেননি। গ্রামীণ ব্যাংকের পেনশনের টাকার জন্য কাউকে একদিনও আটকে রাখেননি। তার মধ্যে শিশুসুলভ সব কিছু আচরণ আমরা লক্ষ করতাম। কারও ছবি তোলার আবদারকে কখনো তিনি নাকচ করেননি। যদি সরকার নিগৃহীত না করত, তাহলে তিনি বাংলাদেশের মানুষের জন্য আরও অনেক কাজ করতে পারতেন।
জোবরা-বাথুয়া গ্রামে উৎসবের আমেজ
প্রত্যন্ত বাথুয়া গ্রাম আলোকিত করে জন্ম নেওয়া অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সেই গ্রামে বয়ে গেছে উৎসবের আমেজ। ২০০৬ সালেও ড. ইউনূস নোবেল জয়ের পর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল বাথুয়া গ্রামে। এবারও সেই উৎসব, উচ্ছ্বাস যেন আরও ছাড়িয়ে গেছে। ড. ইউনূসের কাছে নানা প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন বাথুয়া গ্রামের বাসিন্দারা।
বিশ্বজুড়ে অনন্য উচ্চতায় আসীন এই ব্যক্তিত্বের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের স্মৃতিবিজড়িত হাটহাজারীর প্রত্যন্ত জনপদ। শহরের পৈতৃক বাড়িটিও অনেক ঘটনার সাক্ষী। সেই জোবরা গ্রামও এখন বিখ্যাত, যেখান থেকে শুরু গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম।
ড. ইউনূসের চাচাতো ভাই ব্যবসায়ী শওকত ইকবাল দুলাল কালবেলাকে বলেন, আমাদের পরিবারের একজন সদস্য এমন একটি দায়িত্ব পাওয়ায় আমরা গর্বিত। আমাদের ঐতিহ্যবাহী পরিবার। আমাদের গ্রামের বাড়ি বাথুয়ায় হলেও লেখাপড়া এবং চাকরির সুবাদে আমরা চট্টগ্রাম-ঢাকায় অবস্থান করছি। প্রতি ঈদের সময় গ্রামের বাড়িতে সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে বাথুয়া গ্রামে উপস্থিত হয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করি। আমার চাচা (ড. ইউনূসের বাবা) এবং বাবার কবর মিসকিন শাহর মাজারে। তাই দুই জায়গাতেই আমাদের যাতায়াত সবসময় রয়েছে। আজ শুক্রবার জুমার নামাজ পড়েও বাড়িতে অপেক্ষা করছি। ড. ইউনূসের বাড়ি দেখতে অনেকেই আসছেন দূর-দূরান্ত থেকে। এটা আমাদের গর্বের এবং খুশির সংবাদ। সুন্দর কাজের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশ দেখব—এটাই প্রত্যাশা রইল।
বাথুয়া গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা শফি কালবেলাকে বলেন, দেশের ক্রান্তিকালে শিক্ষার্থীদের অনুরোধে তিনি দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছেন। এটা আমাদের জন্য গর্বের। আজকে সারা বিশ্ব তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবসময় সাদাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত তিনি। এত সুনাম, এত কীর্তি এত সব কিছুর পরও একটা বাড়ি করেননি। অর্থের প্রতি লোভ-লালসাও নেই। এবার ভালো কিছু প্রত্যাশা করছি আমরা।
জোবরা গ্রামের প্রবীণ চা দোকানি আব্দুল করিম বলেন, জোবরা গ্রামকে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন ইউনূস। নানা সমস্যা থাকলেও এই ঋণের মাধ্যমে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। এটি এখনো চলমান আছে। এই গ্রামটা অনেক অবহেলিত। এই গ্রামের অনেক উন্নয়ন দরকার। গ্রামের ছেলে ইউনূস এখন সরকারের ওপরের স্থানে উঠেছেন শুনেছি। আমরা খুশি। আমাদের এলাকায় আরও ভালো কাজ হবে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে ইউনূসকে ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন মামলা দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এ মামলা দিয়ে ড. ইউনূসকে মিথ্যা হয়রানি করা হচ্ছে বলে জানান বিশ্বনেতারা। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন থেকে সংগীতজ্ঞ ও অধিকারকর্মী বোনো, এমন ৪০ জন বিশ্বনেতা মনে করেন, বাংলাদেশে হয়রানির শিকার হচ্ছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সে কারণে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে শেখ হাসিনার কাছে বিশ্বনেতারা একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। সরকারের মেয়াদের বিভিন্ন সময়ে অধ্যাপক ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা হয়। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কয়েকটি অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় মামলায় খালাস দেওয়া হয়েছে তাকে।