সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিগত সরকারের মন্ত্রী এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের পৃথক দুটি অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এর আগে কোটা আন্দোলনে নিহত আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা বুলবুল কবির গত বুধবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নয়জন এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ দাখিল করেন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে নিহত মেহেদীর বাবা মো. সানাউল্লাহর পক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার আরও একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অভিযোগেও শেখ হাসিনা ছাড়া গণহত্যায় অভিযুক্ত করা হয়েছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশিদ, সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন আর রশিদকে। এ ছাড়া আবেদনে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে তৎকালীন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য, কতিপয় অসাধু র্যাব কর্মকর্তা ও সদস্য এবং কতিপয় অজ্ঞাতনামা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত শত শত হত্যাকাণ্ড নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই এই অভিযোগের তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। প্রকাশিত এসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে সংস্থাটি। এরপর আসামি গ্রেপ্তারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী দলের প্রধান তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আতাউর রহমান।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, যত দ্রুত তদন্ত শেষ করা যায় সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। গণহত্যার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা হওয়ায় সাক্ষী-সাবুদ পেতে সমস্যা হবে না। এ ছাড়া মামলার অনেক আসামি অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশ হেফাজতে আছেন। ফলে আসামি গ্রেপ্তারেও আমাদের বেগ পেতে হবে না। তাই দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রসিকিউশনের কাছে যাতে রিপোর্ট হস্তান্তর করতে পারি, সে চেষ্টাই করা হচ্ছে। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশজুড়ে সংঘটিত হত্যা, নির্যাতন ও সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো তদন্তের আওতায় আনা হবে।
গণহত্যার আরেক অভিযোগ:
কোটা সংস্কার আন্দোলনে গত ২০ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ডাচ বাংলা ব্যাংক মার্কেটের পেছনে মো. মেহেদী নামে এক ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। নিহতের পিতা মো. সানাউল্লাহর পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থায় বৃহস্পতিবার অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, কোটা আন্দোলন ঘিরে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৪৩৯ জন আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে পুলিশ-র্যাব সদস্য ও আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে। শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কতিপয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাদের নির্দেশে ও পরিকল্পনায় কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া কয়েক হাজার আন্দোলনকারী আহত ও স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে। তাদের এই কার্যক্রম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২), ৪(১)(২) ধারা অনুযায়ী গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ।
এর আগে গত বুধবার কোটা আন্দোলনে নিহত আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা বুলবুল কবির সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থায় আবেদন করেন। এই অভিযোগেও দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। দুটি অভিযোগের একসঙ্গে তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। অভিযোগকারী পক্ষের আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম এ বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। সেইসঙ্গে একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়েছে এবং ঘটনার সময়ের পত্রিকা সংগ্রহ করে পর্যালোচনা শুরু করেছেন।’
‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও দুই হত্যা মামলা’
এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এক মামলায় শিক্ষার্থী ও আরেক মামলায় অটোরিকশাচালককে গুলি করে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ দুটি মামলা দায়ের হয়। শুনানি শেষে আদালত শেরেবাংলা নগর ও মোহাম্মদপুর থানাকে এ দুটি মামলা এজাহার হিসেবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। এ নিয়ে গত তিন দিনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানাধীন এলাকায় শাহাবুদ্দিন নামে এক অটোরিকশাচালককে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ফারহা দিবা ছন্দার আদালতে মামলার আবেদন করেন মো. আবুল কামাল নামে এক ব্যক্তি। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশকে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক সেতু ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন-অর-রশীদ, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমগ্র বাংলাদেশে অগণিত ছাত্র ও সাধারণ জনতা পুলিশের গুলিতে হতাহত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে ভিকটিম তার পরিবারের সদস্যদের জন্য খাবার আনতে গিয়ে ঘটনাস্থল শেরেবাংলা নগর থানার সামনে পশ্চিম আগারগাঁও চৌরাস্তায় উঠার সময় হঠাৎ ভিকটিম শাহাবুদ্দিনের মাথায় পুলিশের ছোড়া গুলি বিদ্ধ হয়। এরপর ঘটনাস্থলের রাস্তায় ভিকটিম লুটিয়ে পড়লে। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে (এনআইএনএস) নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে, গুলিতে মোহাম্মদপুর থানার দারুননাজাত ইসলামিয়া মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জোবাইদ হোসেন ইমন নিহতের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালতে মামলাটি করেন ইমনের মামা আব্দুল্লা আবু সাইদ ভূঁইয়া। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশকে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক সেতু ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. এ আরাফাত, শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন-অর-রশীদ, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ড. খ মহিদ উদ্দিন এবং অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিবির সাবেক প্রধান হারুন-অর-রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। এ ছাড়া র্যাবের হেলিকপ্টার টহল টিমের অজ্ঞাতপরিচয় সদস্য ও তাদের কমান্ডিং অফিসারদের অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্রসমাজ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করলে ইমন গণআন্দোলনের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে শরিক হয়। ছাত্রজনতার আন্দোলনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই গণভবনে প্রেস কনফারেন্সে আন্দোলনকারী ছাত্রদের রাজাকারের বাচ্চা বলে অভিহিত করেন। এতে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আরও জোরদার করে। এ অবস্থায় ওবায়দুল কাদের ১৫ জুলাই ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের মোকাবিলা করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট’ মর্মে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে ছাত্রলীগকে গণহত্যার নির্দেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, হাছান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনদের পরিকল্পনায় ও প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় আন্দোলনকারীদের নিষ্ঠুরভাবে দমনের জন্য নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের দেখামাত্র গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন। তাদের এ নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর জন্য নিজ নিজ বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, হারুন-অর-রশীদ, হাবিবুর রহমান। তাদের নির্দেশে বাস্তবায়ন করেন অধস্তন কর্মকর্তারা। ১৯ জুলাই র্যাব সদস্যরা মোহাম্মদপুর আল্লাহ করিম মসজিদে হেলিকপ্টারে গুলি ছোড়ে। এর একটি গুলি ইমনের বাম কানের ওপর দিয়ে প্রবেশ করে ডান কানের নিচ দিয়ে চোয়াল ভেদ করে বেরিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ইমন।