সানাউল হক সানী
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৩১ এএম
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৩১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সচিবের এতিমখানায় বরাদ্দ হয় ‘৮০ ভূতের’ নামে

অনিয়ম-দুর্নীতি
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. খায়রুল আলম সেখ। ছবি : সংগৃহীত
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. খায়রুল আলম সেখ। ছবি : সংগৃহীত

মো. খায়রুল আলম সেখ। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ পান গত বছরের অক্টোবরে। সচিব হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই নিজ গ্রাম ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন এতিমখানা। নাম ‘পশ্চিম চরবর্ণী নরীরন্নেসা এতিমখানা ও মাদ্রাসা’। মাদ্রাসাটির সরকারি অনুমোদন পায় চলতি বছরের মে মাসে। তবে নিজের প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠার পরপরই অর্থ বরাদ্দ নেন সচিব। এমনকি ওই সময় একজন এতিমও সেখানে পড়াশোনা করতেন না। বর্তমানে ওই মাদ্রাসায় একজনও এতিম নেই। যদিও ৮০ জন এতিমের পড়াশোনা এবং

থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা বাবদ সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে এতিমখানায় বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় এক ব্যক্তি রসিকতা করে বলেছেন, ‘এখানে একজনও এতিম নেই। ওই ৮০ জন মনে হয় ভূত।’

শুধু এতিমখানায়ই নয়, সচিব হওয়ার দুই মাসের মধ্যেই বাবার নামে ‘আয়েন উদ্দিন সেখ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’-এর নিবন্ধন নেন খায়রুল আলম। এরপর সেখানেও বরাদ্দ দেওয়া হয় সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে।

নথিপত্র বলছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই নিজের মায়ের নামে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন খায়রুল আলম সেখ, যার নিবন্ধন নেওয়া হয় চলতি বছরের মে মাসে। নিয়ম অনুসারে নিবন্ধন নেওয়ার পরও কিছুদিন সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠান দেখভাল করে। এরপর সন্তোষজনক মনে হলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে অর্থ সহায়তা দেয়। তবে সচিবের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়মনীতি মানা হয়নি। চলতি বছরের মে মাসে এই প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন পেলেও সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে জানুয়ারি মাস থেকে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ম অনুসারে, প্রত্যেক অর্থবছরে দুবার বেসরকারি এতিমখানার জন্য অর্থ ছাড় করা হয়, যাকে বলা হয় ক্যাপিটেশন গ্রান্ট। ন্যূনতম ১০ জন এতিম নিবাসী নেই, এমন কোনো এতিমখানার জন্য ক্যাপিটেশন গ্রান্ট বরাদ্দ দেওয়া যায় না। সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন নেই অথবা এতিম শিশু নেই—এমন কোনো এতিমখানাকেও ক্যাপিটেশন গ্রান্ট বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। অধিদপ্তরের নিয়মে আরও বলা আছে, যতজন এতিম শিশু থাকবে, তার ৫০ শতাংশের নামে বরাদ্দ দিতে পারবে সমাজসেবা অধিদপ্তর। প্রত্যেক শিশু মাসিক ২ হাজার টাকা বরাদ্দ পাবে।

তবে সচিবের মায়ের নামে হওয়া এতিমখানায় এতিম দেখানো হয়েছে ৮০ জনকে। সেই হিসাবে প্রতি মাসে ৪০ জনের নামে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে টাকা তোলা হয়। সরেজমিন পশ্চিম চরবর্ণী নরীরন্নেসা এতিমখানা ও মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি একচালা টিনের ঘরে চলছে মাদ্রাসার কার্যক্রম। পাশেই মাদ্রাসাটির সাইনবোর্ড রয়েছে, যেখানে প্রতিষ্ঠাকাল লেখা ২০২১ সাল। তবে এই মাদ্রাসায় আবাসিক কোনো ব্যবস্থা নেই। যদিও সমাজসেবা অধিদপ্তরের শর্ত অনুসারে এতিম থাকার পাশাপাশি মাদ্রাসায় আবাসিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। অবশ্য মাদ্রাসার সামনেই একটি পাকা ভবনের নির্মাণকাজ চলছে।

এতিমখানা ও মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৭-৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের সবার বাড়িই চরবর্ণী গ্রামে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললে এরা প্রত্যেকেই জানায়, বেতন দিয়েই এই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে তারা। এর মধ্যে মাত্র একজন শিক্ষার্থী রয়েছে যার বাবা নেই।

মাদ্রাসা-সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কালবেলাকে বলেন, মাদ্রাসাটি মাত্র দেড় বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতিম শিশু নেই। বরাদ্দ আসার বিষয় তারা জানেন না। মাদ্রাসাটি পরিচালনা করেন সচিব খায়রুল আলম সেখের ভাগনে মিজানুর রহমান। পরিচালনা পর্ষদের বাকি সদস্যরাও তার স্বজন। কথা হয় স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। এই প্রতিবেদকের প্রশ্ন শুনেই তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘এই এতিমখানায় সরকারি বরাদ্দ আসে না কি, জানতাম না তো! এখানে তো একজনও এতিম নাই। যেই ৮০ জন এতিমের কথা বললেন, তারা মনে হয় ভূত!’

অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যেই খায়রুল আলম সেখ বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আয়েন উদ্দিন সেখ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে যার নিবন্ধনও মেলে প্রতিষ্ঠার পরপরই। এর কিছুদিনের মধ্যেই মন্ত্রণালয় অধিভুক্ত সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ‘আয়েন উদ্দিন সেখ মেমোরিয়াল বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন’ শিরোনামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়, যেখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ কোটি টাকা।

পশ্চিম চরবর্ণী এলাকায় কথা হয় স্থানীয় অনেকের সঙ্গে। তারা সবাই বলছেন, আয়েন উদ্দিন সেখ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা তারা শোনেননি। যদিও সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ম অনুসারে যে কোনো প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এনজিওর সক্ষমতা বিবেচনা করা হয়। কারণ গ্রাম এলাকায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অর্থ সরকার দিলেও বাকিটা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয়। এ ছাড়া যে ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়া হবে, সে সংক্রান্ত পূর্ব-অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের।

ভাইকে রোগী দেখিয়ে তোলা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা:

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র এবং নথিপত্র বলছে, খায়রুল আলম সেখের আপন ছোট ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ফরিদপুর জেলা কার্যালয় থেকে এই নামে ৫০ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, আব্দুল্লাহ আল মামুন জন্মগতভাবে হৃদরাগে আক্রান্ত। তবে তথ্য বলছে, আব্দুল্লাহ আল মামুনের বর্তমান বয়স ৫৫ বছর। জন্মগত রোগের ক্ষেত্রে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত এ ধরনের সুবিধা পেতে পারেন। এ নিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সচিব খায়রুল আলম সেখ নিজের প্রভাব খাটিয়ে ভাইয়ের নামে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন।

অথচ পশ্চিম চরবর্ণী গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খায়রুল আলম সেখের ভাই জন্মগত কোনো রোগে আক্রান্ত নন। এমনকি তিনি অসুস্থও নন। এ বিষয়ে ফের যোগাযোগ করা হয় সমাজসেবা কার্যালয়ে। তবে সেখানকার সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শুধু সচিবের ভাই নন, আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতিজনের অনেকেই অসুস্থতা দেখিয়ে অর্থ বরাদ্দ নিয়েছেন।

সচিবের ইচ্ছাতেই বদলি-পদায়ন:

এদিকে সচিবের একক আধিপত্য তৈরি করতে নিজের পছন্দমতো কর্মকর্তাদের বদলি এবং পদায়নে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সচিবের অপসারণ চেয়ে আন্দোলনও করছেন কর্মকর্তারা। এমনকি যেসব কর্মকর্তা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদেরকেও বদলি করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলছেন, একতরফা নির্বাচনের পরে গত ১১ জানুয়ারি টানা চতুর্থবারের আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরপরই বদলি বাণিজ্য শুরু করেন সচিব খায়রুল আলম সেখ। একদিনেই বদলি করা হয় সাতজন কর্মকর্তাকে। এরপর নিজের আধিপত্য বাড়াতে আরও বেশ কয়েকজনকে বদলি এবং পদায়ন করেন তিনি। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও বেপরোয়া আচরণ অব্যাহত রাখেন খায়রুল সেখ। অন্তত ১০ জন কর্মকর্তাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়। এ ছাড়া নিজের সিন্ডিকেটকে টিকিয়ে রাখতে পছন্দের লোকদের রাজধানী এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে পদায়নের ব্যবস্থাও করছেন খায়রুল সেখ। প্রায় দেড় সপ্তাহ ধরে এ নিয়ে আন্দোলন করছেন কর্মকর্তারা।

যা বললেন সচিব:

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. খায়রুল আলম সেখের সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এর (অনিয়ম) সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সবকিছু নিয়ম মেনেই হচ্ছে। মাদ্রাসাটি স্থানীয়রা করেছেন আমার মায়ের নামে। সেখানে ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।’ এতিম কতজন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা তো আমি জানিও না।’ এরপর ভাইয়ের অনুদানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ভাই অসুস্থ। হার্টের রোগী। হাজার হাজার মানুষ অনুদান পায়, সেভাবেই সে পেয়েছে।’ বাবার নামে হাসপাতালের বিষয়ে তার বক্তব্য—‘ওই প্রকল্পটি আমরা বাতিল করেছি।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সকাল থেকে মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক

প্রতিষ্ঠার ১৯ বছর / বিদেশে সরাসরি মাস্টার্সে ভর্তি হতে পারছেন না কুবি শিক্ষার্থীরা

সুপারসনিক বিমানের সফল পরীক্ষা, কী আছে এতে

ঘরে মুরগির মাংস দেখে সেজদায় লুটিয়ে পড়ল শিশু

ব্রাজিলে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, কী হচ্ছে সেখানে

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

আজ ৩৬ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

তিস্তা নদী রক্ষার দাবিতে শিক্ষার্থীদের ব্যতিক্রমী ফ্ল্যাশ মব

পুলিশকে মারধর করে হাতকড়াসহ পালানো সেই আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

গাজায় হামলা থামেনি, শতাধিক নিহত

১০

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

১১

মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে বাড়ি যাওয়ায় পায়ে শিকল বেঁধে শিশুর পাঠদান

১২

মধুপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাবলু আটক

১৩

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৪

৩০ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৫

চট্টগ্রামে বর্জ্য থেকেই তৈরি হবে গ্রিন ডিজেল ও অ্যাভিয়েশন ফুয়েল

১৬

রাজধানীতে আ.লীগ নেতা মানিক দর্জি গ্রেপ্তার

১৭

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে চাঁদাবাজি-দুঃশাসনমুক্ত দেশ গড়বে : কফিল উদ্দিন

১৮

আফগানিস্তান নয়, বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নেপাল

১৯

এবার বার্সায় আরও বড় দুঃসংবাদ

২০
X