অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সেনাবাহিনী দিয়ে, পুলিশ দিয়ে, র্যাব দিয়ে আনন্দ-উৎসব করার আয়োজন করতে যাওয়াটা আমাদের ব্যর্থতা। তবে এমন দেশ গড়তে চাই, যা নিয়ে দুনিয়ার সামনে গর্ব করা যায়। আমরা এ দেশের নাগরিক হিসেবে সেই স্বপ্নের রাষ্ট্র গঠন করতে পারি।
গতকাল শনিবার বিকেলে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে দুর্গাপূজা উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে তিনি মন্দিরে পৌঁছলে তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর, সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেবসহ পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর পূজা কমিটির নেতারা। এ সময় পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর পূজা কমিটির নেতারা প্রধান উপদেষ্টাসহ তার সঙ্গীদের মন্দিরের বিভিন্ন স্থান ঘুরিয়ে দেখান। পরে প্রধান উপদেষ্টা হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
ড. ইউনূস বলেন, এবার দুর্গাপূজার আনন্দ বিশেষ আনন্দে পরিণত হয়েছে। দেশজুড়ে যেটা সবাই উপভোগ করছে। এ আনন্দ আরেকটু বেড়ে গেল এ জন্য যে, একদম নির্বিঘ্নে সব জায়গায় পূজার অনুষ্ঠান হচ্ছে। সবাই চেষ্টা করেছে কোনোরকম দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, কোনো আতঙ্কজনক পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়।
গৌরবপূর্ণ দুর্গাপূজা করতে পারার কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এর পেছনে আমাদের সহযোগিতা করেছে পুলিশ, সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, সরকারের কাছে যত ধরনের শান্তিরক্ষা বাহিনী ছিল—সবাই। সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করেছে। এটা কঠিন কাজ, সহজ না। এই কঠিন কাজটি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সমাধা করতে পেরেছে। সবাই মিলে কাজ করলে যে সফলতা পাওয়া যায়, সেটা তারা প্রমাণ করেছে। তারা কষ্ট করার কারণে আমরা ছুটি উপভোগ করতে পারছি। তাদের ধন্যবাদ জানাই।
ড. ইউনূস বলেন, সমাজের যে কোনো অংশ উৎসব করবে, আমরা সবাই মিলে সেখানে শরিক হবো, তারা যেন নির্বিঘ্নে, আনন্দ সহকারে উৎসব করতে পারে। তারা নিজেরা এই আনন্দে অংশ নেবে, এটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা ওটা করতে পারছি না। এটা করতে পারছি না বলেই আমাদের ছাত্র-জনতা, শ্রমিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটা নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে আজ আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই যে আমরা আপনাদের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে উৎসবের সুযোগ করে দিলাম। এটা যেন ভবিষ্যতে আর কখনো করতে না হয়, সেজন্য আমরা একযোগে কাজ করব। আমরা এমন এক বাংলাদেশ তৈরি করতে চাই, যে বাংলাদেশে সবার সমান অধিকার থাকবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৩ আগস্ট ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন ড. ইউনূস। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি বলেন, একটা বড় রকমের বিভেদের আওয়াজ শুনছি। বিমানবন্দরে নেমেই যেটা বললাম, এমন বাংলাদেশ আমরা করতে চাচ্ছি, যেখানে আমরা এক পরিবার। এই হলো মূল জিনিস। পরিবারের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা, বিভেদ করা, এটার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ—এটাই আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এটা নিয়ে যেন আর কোনো বাদ-বিবাদ ইত্যাদি না হয়।
তিনি বলেন, আমাদের গণতান্ত্রিক যে আকাঙ্ক্ষা, সেখানে আমরা বিবেচিত মুসলমান হিসেবে নই, হিন্দু হিসেবে নই, বৌদ্ধ হিসেবে নই, মানুষ হিসেবে। আমাদের অধিকারগুলো নিশ্চিত হোক। সব সমস্যার গোড়া হলো, আমরা যত প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন করেছি, সবকিছু পচে গেছে। এ কারণেই গোলমালগুলো হচ্ছে। কাজেই আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনগুলো ঠিক করতে হবে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, এটা এমন রোগ (বিভেদ), যার মূলে যেতে হবে। আপনারা যদি বলেন, আমাদের সংখ্যালঘু হিসেবে এটা বলছে, এটা হলো মূল সমস্যা থেকে আপনারা দূরে সরে যাচ্ছেন। আমাদের বলতে হবে, আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সেটা পেলে আমাদের বাক-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হবে—যেগুলো আছে, আমরা নতুন কিছু বলছি না। আমাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটাই হলো আমাদের মূল লক্ষ্য।
তিনি বলেন, আপনারা যদি টেনে টেনে নিয়ে আসেন, আমি অমুক, আমি তমুক—এটা আবার পুরোনো খেলায় চলে গেলেন। আপনাদের শিকার করার জন্য যারা বসে আছে, তারা এগুলো শিকার করে। আপনারা বলবেন, আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমার সাংবিধানিক অধিকার আমাকে দিতে হবে। সব সরকারের কাছে এটাই চাইবেন, আর কিছু চাইবেন না আপনারা।
গ্রামীণ ব্যাংকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই অধ্যাপক বলেন, আপনি শুনবেন না গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাসে আমরা হিন্দুপাড়া বলে বাদ দিয়ে মুসলমানপাড়ায় চলে গিয়েছি। কখনো হয়নি। একসঙ্গে গিয়েছি, একভাবে গিয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের মূল কাজটায় যেতে হবে। আপনাদের অনুরোধ, আপনারা বিভিন্ন খোপের মধ্যে চলে যাইয়েন না। এই খোপ হলেই এর মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি লেগে যাবে। একত্রে আসেন, এক আইন। আমরা এসেছি এক মানুষ, এক অধিকার। এর মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যাবে না। আমাদের একটু সাহায্য করেন আপনারা, ধৈর্য ধরেন। করতে পারলাম কি পারলাম না, সেটা পরে বিচার করবেন। যদি না পারি, আমাদের দোষ দিয়েন।