শফিকুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:০১ এএম
আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজনীতিকদের প্রতিক্রিয়া

সংস্কারে কালক্ষেপণ করলে ভুল বোঝাবুঝি হবে

উপরে বাঁ থেকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং নিচে বাঁ থেকে সাইফুল হক, মজিবুর রহমান মঞ্জু, নুরুল হক নুর। ছবি : সংগৃহীত
উপরে বাঁ থেকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং নিচে বাঁ থেকে সাইফুল হক, মজিবুর রহমান মঞ্জু, নুরুল হক নুর। ছবি : সংগৃহীত

রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতের সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য প্রথম ধাপে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশনেরই মেয়াদ বাড়িয়েছে সরকার। এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ পৃথকভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর মধ্য দিয়ে জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংবিধান—এসব খাতে পাঁচটি সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় পেল। আর ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনকে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কার সবারই প্রত্যাশা। সেজন্য দেশের জনগণসহ সব রাজনৈতিক দল সরকারকে সমর্থন এবং সহযোগিতাও করছে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলো তাদের কাজ শেষ করতে পারেনি। ফলে সরকার তাদের আরও সময় দিয়েছে। যদিও নির্ধারিত সময়েই তাদের কার্যক্রম সম্পন্ন করা উচিত ছিল। কেননা, দেশের মানুষ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে পর পর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিতে পারেনি। ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিলম্ব করা ঠিক হবে না। কালক্ষেপণ করলে সরকারের সঙ্গে দেশের জনগণের এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হবে, যা কাম্য নয়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শেখ হাসিনার পতনের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংস্কারের দাবি ওঠে। গত বছরের ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করার ঘোষণা দেওয়া হয়। গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। সেগুলো হলো—নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশনগুলোর প্রধানদের নামও ঘোষণা করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে এসব কমিশন পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে তিন সপ্তাহ সময় লেগে যায়। গত বছরের ৩ অক্টোবর ৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি হয় ৭ অক্টোবর। কমিশনগুলো গঠনের পর ৯০ দিনের মধ্যে সরকারের কাছে তাদের সংস্কার প্রস্তাব দিতে বলা হয়।

অন্যদিকে গত বছরের ১৭ অক্টোবর আরও ৪টি সংস্কার কমিশন গঠনের কথা জানায় সরকার। সেগুলো হলো—স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। এই কমিশনগুলোও পূর্ণাঙ্গ করতে এক মাস লেগে যায়। এরপর গত ১৮ নভেম্বর এ চারটিসহ মোট পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অন্যটি হলো স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। নতুন এই কমিশনগুলোও কাজ শুরু করেছে। এই কমিশনগুলোকে ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেদন দিতে হবে।

সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট দাখিলের সময় বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল কালবেলাকে বলেন, সংস্কার নিয়ে আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার। আমরা ৩১ দফা জাতির সামনে ঘোষণা করেছি, যা জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করব। কিন্তু উনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) কি সংস্কার করবেন না করবেন, সেটা তারাই বলতে পারবেন। সংস্কার প্রস্তাব তো আমাদের ৩১ দফা আছে, অন্য দলগুলোর প্রস্তাব আছে। আগামী নির্বাচনের পর সব সংস্কার সংসদে উত্থাপন করা হবে। সংসদে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে সংস্কার চূড়ান্ত করা হবে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যেটাকে উপযোগী এবং প্রয়োজনীয় মনে করবে সেই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়িত হবে। এটাই তো গণতন্ত্র। এর বাইরে তো আর কিছু নেই। যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি তাহলে দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। এটা বিশ্বাস না করলে তো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করা হবে না।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের গতকাল কালবেলাকে বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর সময় না বাড়িয়ে যথাসময়ে কাজ শেষ করাটা উচিত ছিল। এমনিতেই সময় চলে যাচ্ছে। আমি আশা করি বর্ধিত সময়ের ভেতেরই বা তার আগেই তারা রিপোর্ট জমা দেবে এবং কোনো ধরনের টালবাহানা করবে না। তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকারের আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া এবং নির্ধারিত সময়েই জমা দেওয়া উচিত ছিল। তার পরও আশা করি, আর যেন বেশি সময় বৃদ্ধি করা না হয়।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গতকাল কালবেলাকে বলেন, সংস্কার কমিশনগুলো নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন করতে না পেরে আরও ১৫ দিন সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন। এটাকে আমি নেতিবাচক হিসেবে দেখছি না। তবে আমি আশা করব, এ সময়ের মধ্যেই কমিশনগুলো তাদের কাজ শেষে সরকারের কাছে রিপোর্ট বা প্রস্তাবনা জমা দেবে। এরপর সরকারের উচিত হবে জানুয়ারির মধ্যেই দ্রুত সেগুলোকে দেখার পরই যাচাই-বাছাই করা। এরপর জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে কার্যকর আলোচনা শুরু করবে। যাতে আমরা ন্যূনতম বোঝাপড়ার জায়গাটা তৈরি করতে পারি এবং জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দেখতে চাই।

তিনি বলেন, সময় বৃদ্ধিতে কারও কারও প্রশ্ন জাগতে পারে যে, সরকার কালক্ষেপণ করছেন কি না? ক্ষমতাকে আরও দীর্ঘায়িত করতে চান কি না? এরকম প্রশ্ন ওঠাটা অস্বাভাবিক না। কারণ সরকার কিন্তু বহু ধরনের বিষয় নিয়ে বসেছে। আমরা তো সরকারকে সমর্থন দিচ্ছি কিন্তু তারা ঠিকমতো গ্রহণ করতে পারছে না। এটা তাদের ব্যর্থতা।

সাইফুল হক আরও বলেন, সরকার প্রতিদিন এমন এমন বাক্স খুলছেন যা আর তারা বন্ধ করতে পারছেন না। সরকার সব ছড়িয়ে ফেলছে, কিন্তু গুছিয়ে আনতে পারছেন না। দেশ কেমন চলছে সচিবালয়ের দিকে তাকালেই তা খানিকটা বোঝা যায়। সেখানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে যে অস্থিতিশীলতা চলছে তা ভালো লক্ষণ নয়। এভাবে চলতে থাকলে সরকারের স্থিতিশীলতাও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দল ও জনগণের নজিরবিহীন সমর্থন থাকা সত্ত্বেও সরকারের ওপর মানুষের আস্থা ও ভরসায় চিড় ধরছে। মনে হয় সরকারও রাজনৈতিক দলকে কিছুটা এড়িয়ে চলছে।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু গতকাল কালবেলাকে বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর যদি কাজ শেষ করতে না পারে সেখানে সময় বৃদ্ধি করলে সমস্যা নেই; কিন্তু আমরা জেনেছি যে, কিছু কিছু কমিশন তাদের কাজ শেষ করেছে। নির্বাচন সংস্কার কমিশন তাদের কাজ মোটামুটি শেষ করেছে। ফলে সবাইকে একসঙ্গে বিছায় দেওয়াটা ঠিক হয়নি। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটার ব্যাখ্যা সরকারকে দিতে হবে। কেননা, জনগণ তো কমিশনগুলোর বক্তব্য জানতে চাইবে। তারা বলুক কেন সময় বৃদ্ধি করেছে?

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর গতকাল কালবেলাকে বলেন, দেখুন—সংস্কার কমিশন কিন্তু একই সঙ্গে গঠিত হয়নি। বিভিন্ন সময় গ্যাপ দিয়ে গঠিত হয়েছে। কমিশনের কাজটা যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হয়নি। এখানে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটা মতামত প্রস্তুত করা দরকার ছিল; কিন্তু তারা প্রক্রিয়া করেছে যে, সবাই লিখিত মতামত দেওয়া। সেটা আমার কাছে যথোপযুক্ত হয়নি। এরপরই তারা (কমিশনগুলো) সময় নিয়েছে। এখন যদি আরও ইনক্লুসিভ করতে চায় সেজন্য সময় নিয়েছে সেটা ভালো। আর যদি কালক্ষেপণের জন্য সময় নিয়ে থাকে সেটি হবে অশনিসংকেত। কারণ নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা দ্বিমত তৈরি হচ্ছে।

নুরুল হক নুর বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে। সরকার নিজেই বলেছে যে, সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট জমা হলেই তারা আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে-পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। সেক্ষেত্রে তো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরও দূরত্ব বাড়াতে পারে। আমরা সবাই রাষ্ট্র সংস্কার চাই। ফলে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো দিয়ে দেওয়া উচিত। তা না হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সন্দেহ তৈরি হবে যে, সরকার কালক্ষেপণ করতে চাচ্ছে। বেশি বিলম্ব হলে ভুল বোঝাবুঝি হবে। সময় বৃদ্ধির আবেদন যৌক্তিক হলে ঠিক আছে; কিন্তু অযৌক্তিক হলে তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার বোঝা যাবে যে, এটি কালক্ষেপণ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইকসু গঠন ও নির্বাচনের গঠনতন্ত্র প্রণয়নে ১১ সদস্যের কমিটি

বনজ কুমারের মামলায় খালাস পেলেন ইলিয়াস

নদীতে চর ধসে আতঙ্কে শতাধিক পরিবার

ওয়াই-ফাইয়ের রেডিয়েশন থেকেও হতে পারে ভয়াবহ রোগ!

আসনসীমা নিয়ে শুনানি শেষ, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ শিগগিরই 

বঙ্গোপসাগরে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, ঝোড়ো হাওয়ার শঙ্কা

মুহূর্তের ব্যবধানেই ভেস্তে গেল বন্দরে ডাকাতির পরিকল্পনা

মেসিকে না পারলেও রোনালদোকে ছাড়িয়ে গেছেন টেইলর সুইফট

কিডনি রোগ হলে কী কী লক্ষণ হবে শরীরে

এবার ৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজির মামলায় সমন্বয়ক রিয়াদ রিমান্ডে 

১০

কাগজপত্র জালিয়াতি করে অধ্যক্ষ হয়েছেন জাকির হোসেন

১১

বিপিএলে ১ বলে ১৫ রান দেওয়া বোলার এবার দিলেন ১ বলে ২২ রান!

১২

পেছাল রাকসু নির্বাচনের তারিখ, প্রতিবাদে শিবিরের বিক্ষোভ

১৩

রুমমেটকে ছুরিকাঘাত, ঘটনাটি সাজানো বললেন ভিপি প্রার্থী জালাল

১৪

ইরানে ফিরলেন আইএইএ পরিদর্শকরা, পরমাণু সহযোগিতা অনিশ্চিত

১৫

জরায়ুমুখের ক্যানসার কেন হয়, কারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন?

১৬

প্রেমিকাকে ফ্ল্যাট ভাড়া দিলেন হৃত্বিক, নেবেন কত রুপি?

১৭

বাজারে চিংড়ির খোলসের ভেতর জেলি, অতঃপর...

১৮

ডিএমপির ডিবিপ্রধান হলেন শফিকুল ইসলাম

১৯

জম্মু-কাশ্মীরে বৈষ্ণোদেবী মন্দিরের পথে ভয়াবহ ধস, ৩০ জনের মৃত্যু

২০
X