বাঁশের বেড়া তৈরি করে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে কোনোরকমে সংসার চালান ইমাম হোসেন। জনতা ব্যাংকের বাড়বকুণ্ড শাখা থেকে গত ৯ আগস্ট একটি নোটিশ আসে তার নামে। নোটিশ পড়ে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে অসহায় মানুষটির। কারণ, ব্যাংক বলছে, ইমাম হোসেন ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকার ঋণখেলাপি। অথচ তিনি কখনো কোনো ব্যাংক থেকে ঋণই নেননি।
শুধু ইমাম হোসেন নন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের মান্দারীটোলা গ্রামের অর্ধশতাধিক মানুষের ওপর ‘গায়েবি’ ঋণের বোঝা চেপেছে। ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ না নিলেও লাখ লাখ টাকা পরিশোধের নোটিশ পেয়ে দিশেহারা গরিব মানুষগুলো। তাদের অধিকাংশই দিনমজুর। তালিকায় আছেন কয়েকজন বিধবাও। আইনের আশ্রয়ের জন্য এখন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বিপদগ্রস্ত মানুষগুলো।
ইমাম হোসেনের স্ত্রী নাসরিন আক্তার কালবেলাকে জানান, সালে করোনা মহামারির সময় সরকারি প্রণোদনা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে প্রতিবেশী আহম্মেদুর রহমান জনতা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে বলেন। অভাবের তাড়নায় কোনো খোঁজখবর না নিয়েই দুটি অ্যাকাউন্ট খুলেন স্বামী-স্ত্রী। সেই সময় তাদের ১ হাজার টাকাও দেওয়া হয়।
প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে কোনোরকমে জীবনযাপন করেন বিধবা মরিয়ম বেগম। করোনাকালে প্রণোদনার আশায় জনতা ব্যাংকে হিসাব খুলেছিলেন তিনিও। কয়েকদিন আগে ব্যাংকের দেড় লাখ টাকা ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়েছেন মরিয়ম বেগম।
একইভাবে সরকারি প্রণোদনার আশায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেন আরও অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ। তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ওই অ্যাকাউন্টগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ঋণ নেন আহম্মেদুর রহমানসহ একটি চক্র। সব মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ কোটি টাকার বেশি। সব ঋণের জিম্মাদার ছিলেন আহম্মেদুর রহমান। যাদের নামে নোটিশ এসেছে, তাদের কেউই ব্যাংক থেকে ঋণ নেননি।
ভুক্তভোগীরা জানান, ব্যাংক থেকে নোটিশ আসার পর তারা আহম্মেদুর রহমানের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি তাদের অভয় দিয়ে সব ঋণ নিজে শোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এর পরই ভোল পাল্টে ফেলেন তিনি। ব্যাংক হিসাবের জিম্মাদার হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও ঋণের দায় নিতে নারাজি আহম্মেদুর।
ব্যাংক ঋণ নিয়ে সাধারণ মানুষের এমন ভোগান্তির বিষয়ে জানার পর সরেজমিন মান্দারীটোলা গ্রামে যান এ প্রতিবেদক। ভুক্তভোগীরা জানান, সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে আহম্মেদুর তার কাছে থাকা ব্যাংকের নথিপত্র আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। তার ঘরে আগুন লেগেছে মনে করে স্থানীয়রা জড়ো হলে তিনি বলেন, ঘরে থাকা পুরোনো কাপড় পুড়িয়ে ফেলেছি। তবে তিনি ব্যাংক ঋণের নথিপত্র পুড়িয়েছেন বলে এলাকাবাসীর দাবি।
এদিকে ব্যাংকের চিঠি পাওয়ার পর আইনি ঝামেলার ভয়ে চিন্তিত ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। তাদের দাবি, আহম্মেদুর রহমান একা নন, ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঋণ নিয়ে এমন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে তারা প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন।
ঋণ জালিয়াতির এ ঘটনা সম্পর্কে অভিযুক্ত আহম্মেদুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমি প্রতিটি অ্যাকাউন্টের জিম্মাদার ছিলাম। কিন্তু ঋণ-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে আমার জানা নেই। তারা সবাই মিথ্যা কথা বলছে।’ বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছাদাকত উল্লাহ মিয়াজী কালবেলাকে বলেন, ‘আমার এলাকার অত্যন্ত নিরীহ কিছু মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে করোনাকালীন বিভিন্ন প্রণোদনের কথা বলে মান্দারীটোলার আহম্মেদুর রহমান তাদের দিয়ে জনতা ব্যাংকের বাড়বকুণ্ড শাখায় অর্ধশতাধিক অ্যাকাউন্ট খুলেন। প্রতিটি অ্যাকাউন্টে জিম্মাদার ছিলেন আহম্মেদুর রহমান। তিনিসহ জনতা ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা আব্দুল্লাহর যোগসাজশে এ ঋণ-সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয়দের মুখে ব্যাংকের মাধ্যমে জানা যায়, ১ কোটি টাকার ওপরে আহম্মেদুর রহমানের ফিক্সড ডিপোজিট আছে। এ টাকার উৎস কোথায়? পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় বলা যায়, তার কাছে বড়জোর ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা থাকার কথা। ফিক্সড ডিপোজিট করা টাকাগুলো সব অসহায় মানুষের। শুনেছি প্রতি ১ লাখ টাকা ঋণের বিনিময়ে তিনি ৩০ হাজার টাকা করে কমিশন নিয়েছেন।’
এ বিষয়ে জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখার ব্যবস্থাপক মিটন ঘোষের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘জনতা ব্যাংকের বাড়বকুণ্ড শাখার ঋণ-সংক্রান্ত বিষয়টি উপজেলার মাসিক পর্যালোচনা সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা লিখিতভাবে অভিযোগ করলে এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মন্তব্য করুন