রাজকুমার নন্দী
প্রকাশ : ১২ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১২ মে ২০২৫, ০৭:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শুধু কার্যক্রম নয় আ.লীগকেই নিষিদ্ধ করতে হবে

বিভিন্ন দলের অভিমত
শুধু কার্যক্রম নয় আ.লীগকেই নিষিদ্ধ করতে হবে

আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তারা বলছেন, সরকারের এ পদক্ষেপ যুক্তিযুক্ত এবং এতে নাগরিকদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে। তবে কয়েকটি দলের অভিমত, সরকারের নির্বাহী আদেশে না হয়ে আদালতের মাধ্যমে এটা হলে আরও ভালো হতো। নেতারা বলছেন, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার গত ১৬ বছর দেশে গুম-খুন, ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে, এমনকি ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যাও চালায়। সুতরাং শুধু দলীয় কার্যক্রম নয়, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকেই নিষিদ্ধ করতে হবে, নিবন্ধনও বাতিল করতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবি। সরকারের নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় গতকাল রোববার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব কথা বলেন।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্তে বিএনপি আনন্দিত বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, প্রাসঙ্গিক আইন সংশোধন করে ফ্যাসিবাদী দলের বিচার করার সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে করেন তারা। তবে বিএনপির দাবি মেনে আরও আগেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে চাপের মুখে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো বিব্রতকর ও অনভিপ্রেত অবস্থায় সরকারকে পড়তে হতো না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিবাদী শক্তি, মাফিয়া শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। দলটি দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদ ও মাফিয়াতন্ত্রের চর্চা করেছে বাংলাদেশের মানুষের ওপর এবং তারা অত্যাচার-নিপীড়ন-নির্যাতন-গণহত্যার মধ্য দিয়ে তাদের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে, নিজেদের রাজনীতির মৃত্যু ঘটিয়েছে। এমন অবস্থায় সন্ত্রাস দমন আইনে সংশোধন এনে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের (আওয়ামী লীগ) রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই।

১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার কালবেলাকে বলেন, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা সেই দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার চেয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় আদালতের মাধ্যমে সেটা করলে খুবই ভালো হয়। আদালতের মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্ত বা রায় এলে সেটা অধিকতর কার্যকরী হয়। সেক্ষেত্রে একটা গ্রাউন্ড তৈরি হয়, আইনি ভিত্তি তৈরি হয়। তিনি আরও বলেন, ১৬ বছরের যে স্বৈরশাসন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার যে নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে, ছাত্র-জনতার ওপর যে গণহত্যা, সেটার বিচার কিংবা সংশ্লিষ্ট দলকে নিষিদ্ধ করা—এটা তো সবারই অন্তরের বাসনা। কিন্তু একটা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে সেটা যাওয়া উচিত।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, গত বছরের ৮ আগস্ট আমি ও আমাদের সংগঠন এলডিপি সর্বপ্রথম জোরালোভাবে দাবি জানিয়েছিলাম—দেশ রক্ষার স্বার্থে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। কারণ, এটি ছিল একমাত্র রাজনৈতিক দল, যারা বারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে গুম, খুন, দমন-পীড়নকে সরকারিভাবে অনুমোদন দিয়েছে। প্রায় নয় মাস পর জনতার প্রতিরোধ, তরুণ প্রজন্মের সাহসিকতা ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত চাপে অবশেষে সেই সিদ্ধান্ত এসেছে—আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই এবং এটিকে ভবিষ্যতের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখি।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই। এবার আরেক দফা দলটির রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটল। গণঅভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগ একভাবে নিষিদ্ধ হয়ে আছে। এখন রাজনৈতিক দল এবং জনগণের বিভিন্ন অংশের একটা ঐকমত্যের ভিত্তিতে আইনগতভাবে বিচারিক কার্যক্রমের দিকে যাওয়া দরকার। স্রেফ একটা নির্বাহী আদেশে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সমীচীন নয়। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের দল কিংবা দলের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করাটা বাস্তবে সংকটের, সমাধান নয়। এ ধরনের দলকে মোকাবিলা করতে হয় রাজনৈতিক, সামাজিক, আদর্শিক, সাংস্কৃতিক কিংবা অর্থনৈতিকভাবে। সে ব্যাপারগুলো বাদ দিয়ে, সিম্পলি কাগজে একটা সিদ্ধান্ত নিলে কোনো একটা দল নাই হয়ে যাবে, এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম এই শীর্ষ নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নটি যত না আইনগত, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। সুতরাং রাজনৈতিক মহলকে যুক্ত করে, স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করে করলে, সেটা টেকসই হওয়ার সম্ভাবনাটা বেশি থাকে। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকার দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা করেনি। অনেকটা এককভাবে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছরে গুম-খুন, অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে, এমনকি ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যাও চালায়। সুতরাং সংশ্লিষ্টদের বিচার এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা—এটা সময়ের দাবি ছিল। তাই সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সেটা না করে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। তারপরও সরকারের এ সিদ্ধান্তে আমরা আনন্দিত।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর) বলেন, মানুষের প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। এতে জনতার প্রত্যাশার একাংশ পূরণ হয়েছে। এ জন্য আমরা সরকারকে সাধুবাদ জানাই। আমরা চাই, অতি দ্রুততার সঙ্গে বিচারিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার শেষ করে রায় বাস্তবায়ন করা হবে এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে। গত ৯ মাসের মতো এই ক্ষেত্রে টালবাহানা করলে জনতা সরকারের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু কালবেলাকে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাহী আদেশে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না দিয়ে আমরা চাচ্ছিলাম বিচারিক প্রক্রিয়ায় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। আওয়ামী লীগ যে সীমাহীন অন্যায়, জুলুম ও লুটপাট করেছে—তাতে এ দলটার বিরুদ্ধে জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ফুঁসে উঠেছে। অতএব সরকারের এই পদক্ষেপ যুক্তিযুক্ত এবং এতে নাগরিকদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে।

বিচার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে খেলাফত মজলিস। গতকাল এক যুক্ত বিবৃতিতে দলটির আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, জুলাই-আগস্ট গণহত্যাসহ এর পূর্বে গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে সংঘটিত বিভিন্ন গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত সত্য। খেলাফত মজলিস গত বছরের ৫ আগস্ট অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময় থেকেই হত্যাকারীদের বিচারের স্বার্থে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম বন্ধ ও নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। অবশেষে শনিবার রাতে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। আমরা সরকারকে অবিলম্বে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার ও নিবন্ধন বাতিল এবং তাদের অপরাধী নেতাকর্মীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করার দাবি জানাচ্ছি।

জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহসভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র রাশেদ প্রধান কালবেলাকে বলেন, ২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলীয় কার্যক্রম চালাতে পারবে না আওয়ামী লীগ। এখন চালাতে পারবে না’র জায়গায় বলা হয়েছে নিষিদ্ধ। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, দলীয় কার্যক্রম নয়, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে, নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। দেশের রাজনীতি এবং জাতীয় নির্বাচনে এ দেশের মানুষ গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ এবং নৌকা প্রতীক দেখতে চায় না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পেহেলগামে হামলার অজুহাতে দুই হাজারের বেশি কাশ্মীরি আটক

দুই দিনের অর্ধদিবস কর্মবিরতির ঘোষণা বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দামের বাবা মারা গেছেন

ফিফা সভাপতির বিলম্বে ক্ষুব্ধ উয়েফা, ফিফা কংগ্রেসে নাটকীয় ওয়াকআউট

শাহবাগ থানা ঘেরাও ঢাবি শিক্ষার্থীদের 

ঈদযাত্রায় বাসের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু

সন্ধ্যার মধ্যে যেসব অঞ্চলে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

পাটক্ষেতে মিলল নারীর পোড়া মরদেহ

পাক-যুদ্ধবিমান ভূপাতিতের দাবিকে ‘বাকওয়াস’ বললেন মার্কিন বিশ্লেষক

বার্সেলোনার লা লিগা জয়ে ইনস্টাগ্রামে মেসির বার্তা

১০

কাকরাইলে জড়ো হচ্ছেন জবি শিক্ষার্থীরা, চলছে অনশনের প্রস্তুতি

১১

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুশইনের আশঙ্কায় বিজিবির কঠোর অবস্থান

১২

রূপপুর প্রকল্প ‘বন্ধের ষড়যন্ত্রের’ প্রতিবাদে বিক্ষোভ

১৩

তৃতীয় দিনের মতো আন্দোলনে জবি শিক্ষার্থীরা

১৪

আনচেলত্তিকে কোচ ঘোষণা করতেই বরখাস্ত ব্রাজিল ফুটবল প্রধান

১৫

পেটে বাচ্চাসহ গরু জবাই, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা

১৬

গোপালগঞ্জে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩ জন নিহত, আহত ১৮

১৭

‘সব দোষ পাকিস্তানিদের’

১৮

দেড় কোটি টাকার কষ্টিপাথরের মূর্তিসহ যুবক গ্রেপ্তার

১৯

ভারতের আরেকটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিতের দাবি পাকিস্তানের

২০
X