দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ১১টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক ৩৩ আসনে উপনির্বাচন দেখল একাদশ জাতীয় সংসদ। সরাসরি ভোটে নির্বাচিতদের আসন বিভিন্ন কারণে ফাঁকা হওয়ায় সর্বাধিক ৩০টি আসনে ৩২ বার উপনির্বাচন হয়েছে। এ ছাড়া একটি সংরক্ষিত আসনেও উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বেশিরভাগ আসনে উপনির্বাচন হয়েছে সংসদ সদস্যের মৃত্যুজনিত কারণে। বিএনপির সংসদ সদস্যদের একযোগে পদত্যাগের কারণে বাকিগুলোতে সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে সাজা, বিজয়ী হয়েও শপথ না নেওয়া ও অন্য নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে পদত্যাগের কারণে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, প্রতিটি সংসদেই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত সর্বাধিক উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে একাদশ সংসদে। নবম সংসদে ৯ আসনে ও দশম সংসদে ১৫ আসনে উপনির্বাচন হয়।
জানা গেছে, একাদশ সংসদে ৩৩ আসনের ২৪টিতে সংসদ সদস্যদের মৃত্যু হওয়ায় উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংরক্ষিত আসনসহ সাত আসনে বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে আবারও ভোট হয়। এর মধ্য ছয়টিতে সরাসরি ভোট হয়। একটিতে এমপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সেখানে উপনির্বাচন হয়। আরেকটিতে এমপি আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় সদস্যপদ বাতিল হওয়ায় উপনির্বাচন হয়। এ ছাড়া দুটিতে দুবার করে উপনির্বাচন হয়। একটিতে বিএনপির এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরও শপথ না নেওয়া, অন্যটিতে দুজন সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণ করায় উপনির্বাচন হয়।
সংসদ সদস্যদের মৃত্যুর মিছিলে সর্বশেষ যোগ হয়েছেন চট্টগ্রাম-১০ আসনের এমপি আফছারুল আমীন। ২ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় সরকারদলীয় পাঁচবারের এই এমপির মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হওয়ায় উপনির্বাচনের সংখ্যা গিয়ে ঠেকল ৩৩-এ। এই আসনে উপনির্বাচন আগামী ৩০ জুলাই। ঢাকা-১৭ আসনের এমপি চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের মৃত্যুতে গত ১৫ মে থেকে আসনটি শূন্য হলেও এখনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। আসনটিতে উপনির্বাচন আগামী ১৭ জুলাই।
একাদশ জাতীয় সংসদে উপনির্বাচনের মিছিল শুরু হয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুতে। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও শপথ গ্রহণ করতে পারেননি। ২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
পরে উপনির্বাচন হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জয়ী হওয়া আসনে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৬ থেকে মির্জা ফখরুল নির্বাচিত হলেও ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি শপথ না নেওয়ায় আসনটি শূন্য হয়। সেই উপনির্বাচনে জয়ী হন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর বিএনপির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এমপিরা পদত্যাগ করলে আবারও উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ওই আসনে। এতে ৪৩ বছর পর আসনটিতে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হন।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম-৮ আসনেও দুবার উপনির্বাচন হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে আসন থেকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন মাঈনুদ্দিন খান বাদল। ওই নির্বাচনের মাত্র ১১ মাসের মাথায় ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর বাদলের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমদ নির্বাচিত হন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ মারা যাওয়ায় আবারও শূন্য হয় আসনটি।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে তার সংসদীয় আসন রংপুর-৩ শূন্য ঘোষণা হয়। পরে উপনির্বাচনে তার ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদ (সাদ এরশাদ) বিজয়ী হন।
এ ছাড়া বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একজন নারী সংরক্ষিত আসনের এমপিসহ সাত সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেন। গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগের ঘোষণা দিলে ঠাকুরগাঁও-৩-এর জাহিদুর রহমান, বগুড়া-৪-এর মোশারফ হোসেন, বগুড়া-৬-এর গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২-এর আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩-এর হারুনুর রশীদ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২-এর আবদুস সাত্তার ভূঞার আসনগুলো শূন্য হয়। সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি রুমিন ফারহানাও পদত্যাগ করেন। পরে এ বছরের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে উপনির্বাচন হয়। অন্য কোনো এমপি উপনির্বাচনে অংশ না নিলেও বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে আবদুস সাত্তার ফের নির্বাচিত হন।
কুয়েতের আদালতে শহীদ ইসলাম পাপুলের সাজা হওয়ায় লক্ষ্মীপুর-২ আসনটি শূন্য হয়। কুয়েতের ফৌজদারি আদালত ২৮ জানুয়ারি ২০২১ সালে পাপুলকে নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন ফলে সংসদ সদস্য থাকার পরিপন্থি কাজ করায় ওই আসনেও উপনির্বাচন হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের পক্ষে অংশ নেওয়ায় শেখ ফজলে নূর তাপস পদত্যাগ করলে ঢাকা-১০ আসনে উপনির্বাচন হয়।
এ ছাড়া গাইবান্ধা-৫ আসনে সাতবারের নির্বাচিত এমপি ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী গত বছরের ২২ জুলাই, ফরিদপুর-২ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১১ সেপ্টেম্বর, ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাহারা খাতুন ২০২১ সালের ১০ জুলাই, সিরাজগঞ্জ-১-এর এমপি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ২০২১ সালের ১৩ জুন মৃত্যুবরণ করলে আসনগুলোতে উপনির্বাচন হয়।
টাঙ্গাইল-৭ আসনে একাব্বর হোসেন, সিরাজগঞ্জ-৬-এ হাসিবুর রহমান স্বপন, কুমিল্লা-৭-এ সাবেক ডেপুটি স্পিকার আলী আশরাফ, সিলেট-৩-এ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েছ, কুমিল্লা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল মতিন খসরু, ঢাকা-১৪-তে আসলামুল হক, ঢাকা-৫-এ হাবিবুর রহমান মোল্লা, নওগাঁ-৬-এ ইসরাফিল আলম,
পাবনা-৪-এ শামসুর রহমান শরীফ ডিলু, বগুড়া-১-এ আবদুল মান্নান, যশোর-৬-এ ইসমাত আরা সাদেক, বাগেরহাট-৪-এ ডা. মোজাম্মেল হোসেন, গাইবান্ধা-৩-এ ডা. ইউনুস আলী সরকারের মৃত্যুতে আসনগুলোতে উপনির্বাচন হয়।
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সাবেক সদস্য এবিএম রিয়াজুল কবীর কাওসার কালবেলাকে বলেন, এ যাবৎ একাদশ সংসদ নির্বাচনে উপনির্বাচন বেশি হয়েছে। যদিও আমার কাছে পুরো তথ্য নেই, তবে যতটুকু জানি—এরচেয়ে বেশি উপনির্বাচন আর কোনো সংসদে হয়েছে বলে জানা নেই।
মন্তব্য করুন