

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর অবৈধ সম্পদ জব্দ ও ক্রোক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দুদকের ২৩৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, যেখানে ৫১ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে আসামিদের। তবে মামলা নিষ্পত্তি ও সাজার হারসহ সামগ্রিক কার্যক্রমে দৃশ্যমান ইতিবাচকতা দেখা গেলেও নিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তদন্ত ও কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন থেকেই গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আলোচিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া প্রশংসনীয় হলেও হঠাৎ করে পুরোনো মামলার ঢালাও নিষ্পত্তি, ক্ষমতার নিকটবর্তী ব্যক্তিদের প্রতি নরম অবস্থান এবং সংস্কার প্রক্রিয়ার স্থবিরতা দুদকের স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে সংশয় তৈরি করছে।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ ৯ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য—দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারুণ্যের একতা: গড়বে আগামীর শুদ্ধতা। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের জন্য দুদক দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দিবসটির কেন্দ্রীয় কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন পোস্টার ও ব্যানার প্রদর্শন; গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের শিল্পীদের মাধ্যমে জাতীয় সংগীত পরিবেশন; জাতীয় ও দুদকের পতাকা উত্তোলন, বেলুন-ফেস্টুন ওড়ানো। এ ছাড়া গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, দুদক প্রধান কার্যালয়ের সামনের সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। পাশাপাশি দিবসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
তথ্য বলছে, গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর একই বছরের ডিসেম্বরে দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয় আব্দুল মোমেন কমিশন। এরপর দুদকের তৎপরতা বাড়তে থাকে। একে একে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী এমপি, মন্ত্রী, আমলাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি সামনে আসতে থাকে। এ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করা হয় শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় সাজাও হয়েছে। গত এক বছরে দেশে-বিদেশে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এর মধ্যে দেশে ৪ হাজার ৮১৭ একর জমি, ৮৮টি বাড়ি, ৫২টি বহুতল ভবন, ১৮৩টি ফ্ল্যাট, ৫৫টি প্লট, ৪৫০টি গাড়ি, ১৪টি কমার্শিয়াল স্পেস, আটটি দোকান, একটি মার্কেট, দুটি জাহাজ ও একটি শটগান রয়েছে। বিদেশে জব্দ করা স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট, আটটি গাড়ি ও দুটি বাড়ি। ১৯৮টি কোর্ট আদেশের মাধ্যমে এসব স্থাবর সম্পদ ক্রোক বা জব্দ করেছে দুদক। উল্লিখিত সময়ে দেশে দুদকের অবরুদ্ধ করা অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক হিসাব, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, এফডিআর, বিও অ্যাকাউন্ট ও স্বর্ণ। বিদেশে অবরুদ্ধ করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে অর্থ ও শেয়ার। ২৩৩টি কোর্ট আদেশে এসব সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
এদিকে, গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে ২৩৯টি মামলার নিষ্পত্তি করেছে দুদক। এর মধ্যে ১২২টি মামলায় আসামিরা সাজা পেয়েছেন। অন্যদিকে, ১০৩টি মামলায় খালাস পেয়েছেন আসামিরা। অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি করা হয়েছে ১৩টি মামলা, আর প্রসিকিউশন প্রত্যাহার করেছে একটি মামলা। সে হিসাবে গত এক বছরে দুদকের মামলায় সাজার হার ৫১ ভাগ। এসব মামলায় আদালত আসামিদের জরিমানা করেছেন ৫ হাজার ৫৩ কোটি ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার ৪৯৯ টাকা। এ ছাড়া বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ৩২১ কোটি ৮৮ হাজার ১৯৩ টাকা। বর্তমানে দুদকে পেন্ডিং মামলা রয়েছে ৩ হাজার ১১৯টি। যার মধ্যে স্থগিত রয়েছে ২৪৩টি মামলা, আর বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৮৭৬টি। একই সময়ে মোট ২৮২টি মামলায় চার্জশিট দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক ও দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (ডুসা) সাবেক সভাপতি মো. মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধান প্রতিবন্ধক দুর্নীতি। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা হলো দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণ। সেই লক্ষ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর নতুন কমিশনের নেতৃত্বে আমরা নতুন দুদক দেখতে পাচ্ছি। বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে এ মুহূর্তে দুর্নীতি দমন কমিশন অনেক বেশি তৎপর। সেই তৎপরতাকে এগিয়ে নিতে ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সর্বদাই কমিশনের পাশে থাকবে।
দুদকের কার্যক্রমে ইতিবাচকতার আভাস দেখা গেলেও নিরপেক্ষতা ও সংস্কার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়ে গেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, দুদকের বর্তমান নেতৃত্ব কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে এবং সদিচ্ছা প্রদর্শন করছে, বিশেষ করে গত ১৫ বছরে আলোচিত দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও মামলার ক্ষেত্রে। এগুলো যৌক্তিক উদ্যোগ, কারণ গত দেড় দশকের দুর্নীতির দায় মূলত আগের সরকারের ব্যক্তিদের ওপরই বর্তায়। তবে একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, এ অবস্থানকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখার প্রয়োজন রয়েছে। তার ভাষায়, ‘যেহেতু ওই ব্যক্তিরা এখন আর ক্ষমতায় নেই, তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ। সমালোচকরা এটিকে রাজনৈতিক পক্ষপাত বলতেই পারেন। তবু দুদকের দৃশ্যমান সক্রিয়তাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চাই।’
পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে দায়ের হওয়া মামলা হঠাৎ নিষ্পত্তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আগের সরকারের সময়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা ক্ষমতার বাইরে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো হয়েছিল, সেগুলোর অনেকটাই হঠাৎ করে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। সব মামলা হয়রানিমূলক ছিল—এটা যেমন বলা যাবে না, তেমনি সবই দুর্নীতির মামলা—এটাও বলা যাবে না। কিন্তু নির্বিচারে নিষ্পত্তি প্রশ্নের জন্ম দেয়। এতে এমন সন্দেহ তৈরি হয় যে, দুদক কি নতুন ক্ষমতাকাঠামোর কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিদের রক্ষা করছে? এটি আগের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই পুনরাবৃত্তি কি না—দুদককে সে প্রশ্ন নিজেকেই করতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও দুর্নীতি অব্যাহত রয়েছে বলে মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ের তথ্য এবং বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও দুর্নীতি বহাল রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘সরকারের কিছু উপদেষ্টার কার্যালয়েও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কিছুটা নড়াচড়া দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখানেও দুদক নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পেরেছে কি না, সেটা স্পষ্ট নয়।’
সার্বিক বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মোমেন বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের অন্যতম কারণ দুর্নীতি। আমরা দুর্নীতি নিবারণে চেষ্টা করে যাচ্ছি, কমানো সম্ভব। যদি তারুণ্যকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ রাখা যায়, তাহলে সহনশীল পর্যায়ে রাখা সম্ভব।
তিনি বলেন, অপরাধীদের মতো দুর্নীতিবাজদের রক্ষায় এক ধরনের গডফাদার তৈরি হয়েছে। তারা দুর্নীতিবাজদের রক্ষায় বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছেন। শুধু দুর্নীতিবাজ নয়, সঙ্গে তাদের সহযোগিতা করা গডফাদারদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
ড. মোমেন আরও বলেন, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বেশুমার দুর্নীতির অভিযোগ আসছে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করছি। নির্বাচনে আমরা কাদের নির্বাচিত করছি—সে বিষয়ে ভোটারদের ভাবতে হবে। রাজনীতিবিদ হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত। দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের দিয়ে নির্বাচন করে ভালো কিছু করা সম্ভব নয়। পুরো প্রক্রিয়াটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। দুর্নীতি নিবারণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।
তিনি বলেন, দুদক কোনোরকম চাপের মুখে কাজ করছে না। গত এক বছরে দুদক বেশ ভাইব্রান্ট হয়েছে। আগামী চার-পাঁচ মাসের মধ্যে অনেক মামলা রায়ের পর্যায়ে চলে আসবে।
মন্তব্য করুন