যুক্তরাষ্ট্র সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এই মুহূর্তে ওই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ। শুধু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বা বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোই নয়, বৈঠকটির দিকে চোখ রাখছেন ঢাকা, দিল্লি, ওয়াশিংটনের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বাংলাদেশিরাও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এই ইস্যুতে সরগরম। সবারই জানার আগ্রহ, মোদি ও বাইডেনের আলোচনায় কি বাংলাদেশ প্রসঙ্গ থাকবে?
মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন ধরেই ঢাকা-দিল্লি-ওয়াশিংটনের ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু ভারতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন বন্ধুত্ব রয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বরাবর ঢাকা-দিল্লি একযোগে সিদ্ধান্ত নেয়। তিস্তাসহ নানা অমীমাংসিত ইস্যু সত্ত্বেও গত দেড় দশকে এই ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে। এদিকে, ভারত এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রেরও সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। কথিত রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বরাবর বাংলাদেশকে দেখছে ভারতের চোখে। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে ঢাকা-ওয়াশিংটনের চলমান টানাপোড়েনের সময় কি দিল্লি-ওয়াশিংটনের শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা হবে? কথা হলে মোদি-বাইডেন কোন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করবেন?
সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার সরকারের বারবার অঙ্গীকার সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশকে ব্যাপক চাপে রাখছে। ইতোমধ্যে নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। সেই সঙ্গে বাইডেন বরাবর মার্কিন সরকারি-বিরোধী
কংগ্রেসম্যানদের বাংলাদেশের সরকারের সমালোচনা করে নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে চিঠিসহ নানা তৎপরতাও চলমান রয়েছে। এসব ইস্যুতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গন এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ এ অঞ্চলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ সব বড় শক্তিই বাংলাদেশকে পাশে চায়। চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে এর নেতিবাচক প্রভাব নেই। বরং ভারত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে সব সময় সমর্থন দিয়ে আসছে। আর শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতির কারণে সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশের মাটি ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে না দেওয়ার কারণে ভারত সরকার ও জনগণ শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের প্রতি আস্থা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এমন বাস্তবতায় প্রতিবেশীর ওপর মার্কিন চাপে দিল্লিও অস্বস্তি বোধ করে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ভারত এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কখনো কোনো মন্তব্য বা কূটনৈতিক সীমা লঙ্ঘন করেনি। ভারত বারবার বলেছে, বাংলাদেশের মানুষ কাকে ভোট দেবে, কোন দলকে সমর্থন করবে, তা তাদের নিজস্ব বিষয়। এ বিষয়ে ভারত অনধিকার চর্চা করে না, করবেও না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে বলে ভারত সেই সব ঘটনা থেকে চোখ ফিরিয়েও থাকতে পারে না। এরই প্রতিফলন দেখা গেছে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের সাম্প্রতিক দিল্লি সফরের সময়। সুলিভানের সঙ্গে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের বৈঠকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ বিনষ্ট ও আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।
এ ছাড়া চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীনের দিকে বাংলাদেশের বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কারও জন্যই ইতিবাচক হবে না বলে মনে করে ওয়াশিংটন ও দিল্লি। বাংলাদেশে ‘সুষ্ঠু গণতন্ত্রের স্বার্থে’ আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া জরুরি—যুক্তরাষ্ট্রের এমন মনোভাবের সঙ্গেও একমত ভারত। এসব ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে মোদি-বাইডেনের বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে কথা হবে বলে অনুমান করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, মোদির সফর নিয়ে মঙ্গলবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগ বিষয়ক সমন্বয়ক জন কিরবি বলেছেন, বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে ওয়াশিংটন ইতোমধ্যে তাদের প্রত্যাশা স্পষ্ট করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে ভারত সরকারের যা বলার, সেটা তাদেরই বলতে দেওয়া উচিত। তবে ওয়াশিংটন চায়, দিল্লি ঢাকার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে কথা বলুক।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোদির সম্মানে হোয়াইট হাউসের সাউথ লনে বাইডেন দম্পতি আয়োজিত নৈশভোজ ও সংবর্ধনায় ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ইমরান যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্ব গ্রহণের আগে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন।
মোদির সফরের সময় হোয়াইট হাউসের অনুষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে আমন্ত্রণ জানানোকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছে কূটনৈতিক মহল। তাদের মতে, কূটনীতিতে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য ও অবস্থানের পাশাপাশি কূটনৈতিক আচরণও অনেক ঘটনার আভাস দেয়। তাই ঢাকা-ওয়াশিংটন আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ থাকার বিষয়টা সবাই অনুভব করতে পারছেন।
মন্তব্য করুন