দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিলের আগেই পদত্যাগ করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে আরও চাপে ফেলতে চায় বিএনপিসহ বিরোধী শক্তিগুলো। আজ শনিবার দুপুরে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠেয় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে সরকারকে এই চাপে ফেলতে চায় তারা। গতকাল শুক্রবার রাতে ২০ শর্তে নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি পেয়েছে বিএনপি।
এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও ২০ শর্তে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে পুলিশ। অন্যদিকে, গতকাল রাতে পুলিশ জামায়াতে ইসলামীর আবেদন নাকচ করলেও পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজ মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করতে অনড় অবস্থানে রয়েছে দলটি। সব রাজনৈতিক দলই ইতোমধ্যে তাদের কর্মসূচির সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। তবে ২৮ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর এমন বড় কর্মসূচি ঘিরে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়েছে। মানুষের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। যদিও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই বলছে, তাদের কর্মসূচি হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ।
এদিকে, ঢাকা আসার পথে বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতাকর্মীরা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বলে দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। চেকপোস্ট বসিয়ে অনেক স্থানে শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবুও পুলিশি চেকপোস্ট ও বাধা ডিঙিয়ে নানা কৌশলে ঢাকামুখী ঢল নেমেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের। অসংখ্য নেতাকর্মী এক দিন ও দুদিন আগেই ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। আজকের মহাসমাবেশে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও অংশগ্রহণ করবেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শনিবার আমরা নয়াপল্টনে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ করতে চাই এবং চিঠির মাধ্যমে তাদের (ডিএমপি) বলে দিয়েছি। মহাসমাবেশের উদ্দেশ্যই হচ্ছে, সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে চাপ দেওয়া এবং বাধ্য করা। যাতে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয় ও একদফা দাবি মেনে নিয়ে নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটা নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। তিনি আরও বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করছি। যদি সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল কোনো রকমের বাড়াবাড়ি, অত্যাচার-নির্যাতন করে, তার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। কেননা ইতোমধ্যে সরকারি দল লাঠির কথা বলেছে। এগুলো উসকানিমূলক। একদিকে তাদের সরকারপ্রধান এক রকম বলছেন, অন্যদিকে তারা (প্রশাসন) দমননীতি দিয়ে পুরো জনগণকে জিম্মি করতে চাইছে।
পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী কর্মসূচি: বিএনপির মহাসমাবেশ থেকে কী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে, তা চূড়ান্ত করতে কয়েকদিন ধরে স্থায়ী কমিটিসহ দলের বিভিন্ন স্তরের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ জোট গণতন্ত্র মঞ্চেরও মতামত নিয়েছে। আজ শনিবার সকালে কর্মসূচি চূড়ান্ত হতে পারে। বিএনপি নেতারা জানান, শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে বাধা দেওয়া হলে পরিস্থিতি ভিন্নরূপ ধারণ করতে পারে।
জানা গেছে, বিএনপির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আজকের মহাসমাবেশ থেকে আগামী ৩০ অথবা ৩১ অক্টোবর সচিবালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আসতে পারে। তবে কৌশলগত কারণে সরাসরি ‘ঘেরাও’ শব্দটি ব্যবহার না করে সচিবালয় অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। একই সঙ্গে সারা দেশের জেলা প্রশাসক কার্যালয় অভিমুখেও পদযাত্রা কর্মসূচি আসতে পারে। সচিবালয় অভিমুখে পদযাত্রা নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হবে। তবে পথিমধ্যে পুলিশ বাধা সৃষ্টি করলে তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে কয়েক ঘণ্টার অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করবেন তারা।
আরও জানা গেছে, একদফার চূড়ান্ত আন্দোলনের অংশ হিসেবে সচিবালয় ঘেরাও ছাড়াও পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন অভিমুখী ঘেরাও বা পদযাত্রার কর্মসূচি আসতে পারে। এসব কর্মসূচিতে সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিক্রিয়া, আচরণ কী হয়—সেটির ওপর ভিত্তি করে কর্মসূচির ধরনে পরিবর্তন আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে দাবি আদায়ে টানা অবরোধের কর্মসূচিতে চলে যেতে পারে বিএনপি, এমনকি আসতে পারে হরতালের কর্মসূচিও।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, আমরা মহাসমাবেশের যাবতীয় প্রস্তুতি ভালোভাবে সম্পন্ন করেছি। আশা করি, সরকার কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না। তবে বাধা দিলে পরিস্থিতি ভিন্নতর হবে। এ ক্ষেত্রে কঠোর কর্মসূচির বিকল্প থাকবে না।
সব প্রস্তুতি সম্পন্ন: আজকের মহাসমাবেশ ঘিরে ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। গতকাল রাতেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন। বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতা, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিক দল ও জোটগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে মতামত নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। মহাসমাবেশ সফলের লক্ষ্যে তাদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে নেতাকর্মীদের আগ বাড়িয়ে কিছু না করতে এবং শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ সফল করতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, আজ নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই মহাসমাবেশের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বিএনপি। এর মধ্যে ৮টি বড় ট্রাকের ওপর মঞ্চ তৈরি করা হবে। ওপরে থাকবে দাবি সংবলিত মহাসমাবেশের ব্যানার। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এতে প্রধান অতিথি থাকবেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব মো. আমিনুল হক কালবেলাকে বলেন, সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ সফলের লক্ষ্যে যত রকম প্রস্তুতির দরকার, তার সবই সম্পন্ন হয়েছে। আমরা মহাসমাবেশ অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে করতে চাই।
এদিকে মহাসমাবেশ ঘিরে গণগ্রেপ্তারের অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল জানান, মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত আহত ২ হাজার ৯৫ জন, মামলা হয়েছে ৪১৮টি, গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪ হাজার ২০ জন, আসামি ২৮ হাজার ৫৭০ এবং ৯০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
শাপলা চত্বরেই অনড় জামায়াত: গতকাল রাতে পুলিশ জামায়াতে ইসলামীর আবেদন নাকচ করলেও পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজ মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করতে অনড় অবস্থানে রয়েছে দলটি। গতকাল এক বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে শনিবার শাপলা চত্বরে জনগণের দাবি আদায়ে জামায়াতের মহাসমাবেশ বন্ধ করা যাবে না। আন্দোলনের মাধ্যমেই আওয়ামী সরকারের চূড়ান্ত পতন ঘটানো হবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের প্রচার-মিডিয়া সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার জানান, ১৮ অক্টোবর থেকে গতকাল পর্যন্ত জামায়াতের প্রায় ৪৭৫ নেতাকর্মীকে আটক, নতুন করে মামলা হয়েছে ৩০০, গুম হয়েছেন ১২ জন এবং পুলিশের হামলায় আহত ৪৫ জন।
অন্যান্য দল ও জোটের কর্মসূচি: এ ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ গণতন্ত্র মঞ্চ বিকেল ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে, ১২ দলীয় জোট দুপুর ২টায় বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কের সামনে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট দুপুর ২টায় পুরানা পল্টন আলরাজি কমপ্লেক্সের সামনে, গণফোরাম (মন্টু) ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টি দুপুর ১২টায় আরামবাগের গণফোরাম চত্বরে, এলডিপি বিকেল ৩টায় কারওয়ান বাজার বিএফডিসি সংলগ্ন দলীয় অফিসের সামনে, সকাল ১১টায় বিজয়নগরে এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ সকাল ১১টায় বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক মোড়ে, এনডিএম বিকেল ৩টায় মালিবাগ মোড়ে, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য দুপুর ১২টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে, গণঅধিকার পরিষদ (রেজা-ফারুক) বিকেল ৩টায় পুরানা পল্টন কালভার্ট রোডে, লেবার পার্টি বিকেল ৪টায় পুরানা পল্টন মোড়ে সমাবেশ করবে।