দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল প্রত্যাখ্যান করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে ‘কঠোর’ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও যুগপতে থাকা মিত্ররা। এক মাস ধরে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করলেও আন্দোলনে এখনো চূড়ান্ত সফলতা আসেনি। এ কারণে বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছে। ঘোষিত তপশিলে মনোনয়ন ফরম জমার শেষ সময় এগিয়ে আসা এবং যুগপতের দুই শরিক ভোটে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেওয়ায় আরও বেড়েছে এই হতাশা। এমন পরিস্থিতিতে সামর্থ্য অনুযায়ী রাজপথে থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করলেও হতাশা রয়েছে যুগপতের মিত্রদের মাঝেও। মিত্ররা বলছেন, তাদের সাংগঠনিক শক্তি মূলত সীমিত। যুগপৎ আন্দোলনের সফলতা মূলত নির্ভর করছে প্রধান শরিক বিএনপির ওপর। সে কারণে যুগপতের মিত্ররা বিএনপিকে বর্তমান ‘ঝটিকা কৌশল’ থেকে বেরিয়ে এসে সংগঠিত হয়ে মাঠে নামার পরামর্শ দিয়েছে বলে জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত বর্তমান তপশিলে মনোনয়ন ফরম দাখিলের শেষ দিন আগামী ৩০ নভেম্বর। জানা গেছে, মনোনয়ন ফরম দাখিল ঘিরে ২৯ ও ৩০ নভেম্বর ঢাকায় শক্তভাবে কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। ঝটিকা মিছিলের কৌশল থেকে বের হয়ে ওই দুদিন বিশেষ করে ৩০ নভেম্বর রাজধানী ঢাকাকে মিছিলের নগরীতে পরিণত করতে চান তারা। এ ছাড়া ওই সময় সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে মাঠে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে যুগপতের মিত্ররাও।
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা একাধিক নেতা বলেন, বিএনপি যুগপতের প্রধান শরিক। সারা দেশে দলটির সাংগঠনিক মজবুত ভিত্তি রয়েছে। সুতরাং চলমান আন্দোলনের সফলতা বিএনপির ওপর নির্ভর করছে। এজন্য তাদেরকে ‘ঝটিকা কৌশল’ থেকে বেরিয়ে এসে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। যুগপতে থাকা দলগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মাঠে থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। তবে শরিকদের সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর এটি বিএনপির অজানা নয়।
দশ দফার ভিত্তিতে গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। ঢাকাসহ জেলা শহরে সমাবেশ, পদযাত্রা, অনশন, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলের মতো কর্মসূচি পালন করে দলটি। আন্দোলন একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় বিএনপি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে প্রায় অর্ধশত দল সম্পৃক্ত হয়। এরপর গত ১২ জুলাই থেকে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে একদফার আন্দোলনে নামে বিএনপি। এই সময়েও ঢাকাসহ জেলা শহরে মানববন্ধন, পদযাত্রা, বিক্ষোভ, সমাবেশের মতো কর্মসূচি পালন করে দলটি। তবে সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে যুগপতের মিত্ররা এই সময়ে মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচি পালন করে। যদিও গণতন্ত্র মঞ্চসহ কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপিও কয়েকটি জেলায় কর্মসূচি করে। আর শুরু থেকে যুগপতভাবে দুটি কর্মসূচি করা বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামী পরবর্তী সময়ে এককভাবে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। দলটি ঢাকা ছাড়া জেলা শহরেও কর্মসূচি পালন করে। একপর্যায়ে দুর্গাপূজার পর ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেয় বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপির মিত্ররা ওইদিন ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দেয়। সমাবেশের ঘোষণা দেয় জামায়াতও।
পুলিশের অনুমতি ছাড়াই জামায়াত মতিঝিলে কর্মসূচি সম্পন্ন করে। কিন্তু নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপির কিছু নেতাকর্মী। এরপর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গ্রেপ্তার, অন্যরা আত্মগোপনে এবং তালাবদ্ধ কেন্দ্রীয় কার্যালয় পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকায় কার্যত ব্যাকফুটে চলে যেতে বাধ্য হয় বিএনপি। এমন পরিস্থিতিতে দাবি আদায়ে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে নামে দলটি। গত ২৯ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত সাত দফায় ১৫ দিন অবরোধ এবং দুই দফায় তিন দিনের হরতাল করেছে বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা। এই সময়ে সপ্তাহের দুই ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার ছাড়াও তিনটি মঙ্গলবার কর্মসূচিতে বিরতি দেওয়া হয়।
বিএনপি ও যুগপৎ সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আজ নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আগামীকাল মঙ্গলবার বিরতি দিয়ে চলতি সপ্তাহের শেষ দুদিন অবরোধ অথবা হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে। আর ৩০ নভেম্বর মনোনয়ন ফরম দাখিলের শেষ দিনে হরতাল বা অবরোধের কর্মসূচি শক্তভাবে পালনের লক্ষ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিলের কথাও ভাবছে দলটি। তবে মনোনয়ন ফরম দাখিলের সময় আর না বাড়ালে ডিসেম্বরের শুরু থেকে সাময়িক বিরতি দিয়ে হরতাল-অবরোধের বিকল্প হিসেবে নতুন কর্মসূচিতে যেতে চায় বিএনপি। কর্মসূচিতে বৈচিত্র্য আনা এবং আগামীর আন্দোলনের জন্য নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করতে এমন ভাবনা দলটির। তবে মনোনয়ন ফরম যাচাই-বাছাই, প্রত্যাহার, প্রতীক বরাদ্দসহ তপশিলের প্রতিটি ধাপে শক্তভাবে কর্মসূচি পালন করবে। এই পর্যায়ে বিকল্প কর্মসূচি হিসেবে বিক্ষোভ সমাবেশ, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে জমায়েত কিংবা নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাও নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা চলছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় ঘেরাওয়ের বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় সমাবেশের চিন্তাও রয়েছে বিএনপির। এ ছাড়া ‘ন্যায়বিচার’ বঞ্চিত হয়ে দণ্ডিত এবং কারাবন্দি নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের নিয়ে ঢাকায় মানববন্ধন অথবা উচ্চ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণমূলক কর্মসূচির চিন্তাও করা হচ্ছে। শিগগির এই কর্মসূচি চূড়ান্ত হতে পারে। যুগপতের শরিকরাও সম্প্রতি বিএনপিকে এসব কর্মসূচির পরামর্শ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা যেন স্বাভাবিক পরিবেশে রাজনীতি করতে পারেন, সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি। তবে সরকার শেষ পর্যন্ত একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটলে প্রয়োজন সাপেক্ষে আবার হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে ফিরতে পারে দলটি।
বিএনপির শরিকদের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ (দুই অংশ), গণফোরাম (মন্টু) ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি), এবি পার্টি এবং লেবার পার্টি ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি পালন করছে। এর বাইরে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) এবং এনডিএম হাতেগোনা কয়েকদিন বিক্ষোভ মিছিল করেছে। তবে ঢাকার বাইরে হরতাল-অবরোধের সমর্থনে যুগপতের শরিকদের কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি। এদিকে সম্প্রতি যুগপতের দুই নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অন্য নেতাদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মিছিলের কর্মসূচিতে নেতাদের উপস্থিতি কমে যায়।
এদিকে বিএনপি যুগপতের প্রধান শরিক হলেও হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি বাস্তবায়নে মাঠে দলটির নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। পরিস্থিতি বুঝে তুলনামূলক নিরাপদ সময়ে বিশেষ করে ভোরের দিকে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের ১০-১৫ জন নেতাকর্মী জড়ো হয়ে মিছিল করছেন। পিকেটিংয়ের ক্ষেত্রেও নেই তেমন কোনো তৎপরতা। কোথাও কোথাও ঝটিকা মিছিল বা পিকেটিং থাকলেও তাতে খুব বেশি নেতাকর্মী সমবেত হন না। কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতাকর্মীদের এই ‘ঝটিকা কৌশল’র মিছিল নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও নেতাকর্মীদের হতাশ না হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, ধারাবাহিক আন্দোলন এবং পশ্চিমা বিশ্বের অব্যাহত চাপে শিগগির পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। সেজন্য আরও কিছুদিন আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
সরকার পতনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে চলমান যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ জোট গণতন্ত্র মঞ্চ। আন্দোলনে প্রধান শরিকের কাছে প্রত্যাশা সম্পর্কে মঞ্চের অন্যতম শীর্ষনেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। গায়েবি মামলায় হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের আতঙ্ক নিয়ে আন্দোলনে রয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, এই পরিস্থিতিটা মোকাবিলা করেই বিএনপি মাঠের আন্দোলনে তাদের উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। যুগপতের মিত্ররাসহ সাধারণ মানুষ দেখতে চায়, বিএনপি আরও সক্রিয়ভাবে জমায়েত নিয়ে আগামী দিনের কর্মসূচিতে রাজপথে কার্যকরভাবে উপস্থিত থাকবে। পর্যায়ক্রমে তাদের সেই প্রচেষ্টা আছে বলে ধারণা। আশা করছি, দিন যত যাবে, দেশব্যাপী বিক্ষোভের সংখ্যা বাড়বে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে পরবর্তী সময়ে আন্দোলনে রাজপথের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে বিএনপি আরও সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করবে।