ভিসা নীতির পর সরকারকে চাপে ফেলতে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার ইস্যু সামনে আনার চেষ্টা করছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল। এ বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর বাংলাদেশ বিষয়ক নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে কাজ করছে একাধিক লবিস্ট গ্রুপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও মিলেছে এমন আভাস। আগামী সপ্তাহে দেশটির আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া এবং সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফরে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে। সামগ্রিক আলোচনায় ইতিবাচক ফল না এলে তার পরই দুর্নীতি ও অর্থ পাচার নিয়েও কোনো ঘোষণা আসতে পারে বলে আশঙ্কা ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৫ মে বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভিসা নীতি ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এতে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা সৃষ্টিকারী ও তাদের স্বজনদের ভিসা দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয় দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণা নিয়ে সর্বত্রই ব্যাপক আলোচনা হলেও রাজনীতিতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। বিশেষ করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির অবস্থানের কোনো বদল হয়নি। ফলে নির্বাচনে সব পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে—তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে।
গত ২৭ জুন ‘আর্থিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদন ২০২৩’ শীর্ষক প্রকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যুরো অব ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস অ্যাফেয়ার্স। গত ২ জুলাই ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমেই বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে দুর্নীতি, আর্থিক অস্বচ্ছতা ও অর্থ পাচার প্রসঙ্গ সামনে আনার আভাস দিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত। কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত না হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপে রাখতে এসব বিষয় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ঘোষণা করা হতে পারে—এমনটাই ধারণা তাদের।
জানা গেছে, মার্কিন আর্থিক সহায়তা পায়— এমন দেশগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ প্রতিবেদনটির জন্য ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪১টি দেশের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য সরবরাহ করে ওইসব দেশের মার্কিন দূতাবাস, সরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ মোট ৬৯টি দেশ আর্থিক স্বচ্ছতার ন্যূনতম মানদণ্ড বা শর্ত পূরণ করতে পারেনি। এমনকি এই সময়কালে বাংলাদেশ আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বড় কোনো অগ্রগতিও দেখাতে পারেনি।
এতে বাংলাদেশের আর্থিক স্বচ্ছতার নানা ত্রুটি তুলে ধরে বলা হয়, ‘আর্থিক স্বচ্ছতার ন্যূনতম শর্ত পূরণ করতে হলে একটি সরকারকে অবশ্যই
বাজেট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলো যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করতে
হবে। এর ফলে নাগরিকদের কাছে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আস্থা জোরদার হয়। অথচ প্রতিবেদনে উল্লেখিত সময়কালে সরকার বাজেট প্রস্তাব প্রকাশ করলেও বাজেটের নথি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতি মেনে তৈরি করা হয়নি। সরকারের সর্বোচ্চ হিসাব কর্তৃপক্ষের নিরীক্ষা প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি। এ ছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়েও সাধারণ তথ্য ধারাবাহিকভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ছয় দফা পরামর্শেও সময়মতো প্রতিবেদন প্রকাশ ও আন্তর্জাতিক নীতি মেনে নথি তৈরির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ওয়াশিংটন ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই প্রতিবেদন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচনে আরও কঠোর চাপ দিতে পারে। মানবাধিকার, গণতন্ত্রসহ মার্কিন উদ্বেগের ইস্যুগুলোতে আগামী ফোকাস হবে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও রাজনীতিকদের নজরে রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি শান্তিবিষয়ক মার্কিন সংস্থা ‘ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস’র এক রিপোর্টেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কীভাবে পরিচালিত হবে, বিরোধী দল কতটা শক্তিশালী এবং মার্কিন চাপের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন সরকার, বিএনপিসহ বিরোধী পক্ষগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপ সম্পর্কে অবগত। এ কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই বিএনপিকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বেশ চাঙ্গা দেখা যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন সরকারের এক দফা দাবির আন্দোলন জোরদারে প্রস্তুত হচ্ছে দলটি। নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর বেশ জোরেশোরেই গুম, খুন, হামলা, নিপীড়ন, কর্মসূচিতে বাধা ও রাজনৈতিক মামলা দায়েরের সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের তালিকা করার কথা বলছে তারা। এ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা হতে পারেন—এমন সরকারি কর্মকর্তাদের তালিকা করা হবে, এমন আলোচনাও সামনে আনা হচ্ছে।
অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ আগের মতোই সংবিধানের আলোকে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনে অনড় অবস্থানে রয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে তারা কোনোরকম আলোচনায় যেতেও রাজি নয়। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের তৎপরতা নিয়েও আওয়ামী লীগ নেতারা কঠোর সমালোচনা করছেন।
একাধিক সূত্রের দাবি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। নানা পদক্ষেপের পরও ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন না আসায় আরও কঠোর হতে চায় দেশটি। এই প্রেক্ষাপটে সরকারকে চাপে ফেলতে আর্থিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদন ধরে বড় কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এর আগে মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘একটি বিষয় স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাইছে। তারা ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন চাইছে না। বর্তমান সরকারের যে সেটআপ আছে, এমন অবস্থায় নির্বাচন হলে তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার নিশ্চয়তা নেই বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই তারা এবার বেশ সিরিয়াস। সরকারের সঙ্গে তাদের মূল দ্বন্দ্ব এখানেই। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপও নিয়েছে। র্যাবের নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা নীতির মতো হয়তো সামনে আরও চাপ আসবে। তবে নতুন কী চাপ আসবে, কোন পদ্ধতিতে আসবে, তা সুনির্দিষ্ট করে এখনই বলা মুশকিল।’
তবে জাতিসংঘের বাইরে কোনো একক দেশ বা সংস্থার প্রতিবেদনকে ত্রুটিপূর্ণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। এসব প্রতিবেদন কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় মন্তব্য করে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রতিবেদনগুলো নিরপেক্ষ হয়। কোনো একক দেশ বা সংস্থার গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবেদনগুলোর বিশেষ এজেন্ডা থাকে। এসব প্রতিবেদন যে মানদণ্ড বিবেচনায় তৈরি করা হয়, সেই মানদণ্ডই তো ভূরাজনৈতিক স্বার্থ মাথায় রেখে প্রণীত হয়।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করবেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। প্রতিনিধি দলে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর থাকার কথা শোনা যাচ্ছে। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে লু বেশ পরিচিত নাম হওয়ায় মার্কিন প্রতিনিধিদের এই সফরটিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহল। ধারণা করা হচ্ছে, এই সফরকালে বড় দুই দলকে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় আনার চেষ্টা চালাবেন ডোনাল্ড লু।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র দাবি করেছে, নির্বাচন ঘিরে মার্কিন প্রশাসন কঠোর নীতির পথেই থাকবে। এর কিছুটা নজির মিলেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফরে। বরাবর ভারতের চোখে বাংলাদেশকে দেখে আসা যুক্তরাষ্ট্র এবার যেন বেশ কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। এ কারণেই হয়তো মোদির সফরের সময় বাংলাদেশ ইস্যুতে কী ধরনের আলোচনা হয়েছে—সে বিষয়ে কোনো পক্ষই মুখ খোলেনি। আর এই সফরের পরই ছয় মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশে আসছেন ডোনাল্ড লু।
সূত্র জানায়, ডোনাল্ড লু ও তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উজরা জেয়া দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসবেন। দিল্লি-ওয়াশিংটন শীর্ষ বৈঠকের পরপরই মার্কিন প্রতিনিধিদের ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসার বিষয়টিও বিশেষ বার্তা দেয়। কারণ ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্কে দিল্লির ভূমিকা বরাবরই ইতিবাচক। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জুলাই মাসের সফরগুলোর ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশ ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপ। গত জানুয়ারিতে লুর সফরের পর ঢাকা-ওয়াশিংটন দূরত্ব কিছুটা কমেছিল। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, লুর সফরের পরই দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা মিলবে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গত সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অব্যাহত সম্পৃক্ততাকে স্বাগত জানাই। ইন্দো-প্যাসিফিক, বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগরের মধ্যে কৌশলগতভাবে খুব ভালো অবস্থানে থাকায় বাংলাদেশের ওপর অন্যদের নজর বেড়েছে। সবাই বাংলাদেশকে তাদের দিকে রাখতে চায়। অনেকের ভয়, বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। অথচ আমরা ভারসাম্যপূর্ণ, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছি। বিদেশিরা এ দেশে এলে বৈঠকে এসব নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাওয়া যাবে। এর বাইরে নির্বাচনের বিষয়ে তাদের কোনো ভালো পরামর্শ থাকলে আমরা তা স্বাগত জানাব।’
মন্তব্য করুন