এতদিন মনে করা হতো ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা শুধু দিনেই কামড়ায়। প্রাণিবিজ্ঞানী ও কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, শহরে সক্রিয় উজ্জ্বল আলোর কারণে এ মশার আচরণে পরিবর্তন হয়েছে। এখন রাতেও কামড়াচ্ছে এডিশ মশা। তাই দিনে-রাতে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে।
এডিস মশা মানুষকে কেবল দিনের বেলায় কামড়ায় কি না—এমন ধারণা যাচাই করতে কয়েক বছর ধরে গবেষণা পরিচালনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আগে আমরা জানতাম, এডিস মশা শুধু দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকালে এবং বিকেলে কামড়ায়। কিন্তু আমাদের গবেষণায় সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের ল্যাবরেটরি এবং মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় দেখেছি, এডিস মশা রাতেও কামড়ায়।
কবিরুল বাশার বলেন, শহরে উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এডিস মশার আচরণে পরিবর্তন হয়েছে। অতিরিক্ত আলোর কারণে একে তো মশা দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতে পারছে না। তার ওপর এখন তারা রাতের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গেও খাপ খাইয়ে নিয়েছে। সেইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেও মশা তার আচরণ পরিবর্তন করে নিয়েছে। এখন এডিস মশা দিনের বেলা যেভাবে কামড়ায়, তেমনি রাতেও কামড়ায়। রাতের বেলায় কামড়ানোর হার কিছুটা কম থাকে। এডিস মশা থেকে বাঁচতে এখন দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টাই প্রয়োজনীয় সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই দেখা দেয়। এডিস মশার উপস্থিতি বেশি থাকায় এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন এই কীটতত্ত্ববিদ। তিনি বলেন, চলতি বছর এডিস মশার ঘনত্ব অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে আমরা আশঙ্কা করছি পরিস্থিতি বেশি খারাপ হবে। এরই মধ্যে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যুও হচ্ছে। এ মুহূর্তে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঠেকাতে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। আর এই নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনসাধারণকেও সরাসরি সম্পৃক্ত হতে হবে। আগামী দুই মাস হটস্পট ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রমও চালাতে হবে।
এদিকে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় ৭ হাজার ৮৯৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছেন রাজধানীর সব মানুষ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৭টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৮টি ওয়ার্ডের মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।
জুরাইন, শনির আখড়া, তালতলা, খিলগাঁও, বাড্ডা, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ডেঙ্গুর আক্রান্ত রোগী বেশি। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, জ্বর, কাশি, শরীর ব্যথা, বমিসহ নানা উপসর্গের পাশাপাশি প্লাটিলেটও অনেক কমে যাচ্ছে। বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে রোগীদের।
সম্প্রতি এক তথ্যবিবরণীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি হওয়ার পাশাপাশি দুটি লক্ষণ দেখা দিলে ডেঙ্গু সন্দেহে নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। লক্ষণ দুটি হলো—তীব্র মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, শরীরের পেশি ও জয়েন্টে ব্যথা এবং বারবার বমি করার প্রবণতা।
তীব্র ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে জানিয়ে তথ্যবিবরণী বলা হয়েছে, ডেঙ্গু হওয়ার তিন থেকে সাত দিন এর তীব্র লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। এর মধ্যে শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া, তীব্র পেট ব্যথা, ক্রমাগত বমি করা, বমির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া এবং শরীরে অবসাদ বোধ করা ও অস্থিরতা বোধ করা ডেঙ্গুর অন্যতম লক্ষণ।
আরও দুজনের মৃত্যু: ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর প্রাণঘাতী এই রোগে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৬৪-এ। নতুন করে ৬৬১ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৪৩৩ জন এবং ঢাকার বাইরের ২২৮ জন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি মোট রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ১২৯। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ১১৬ জন। এর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৮৯৯ জন। আর ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ২১৭ জন।
অভিযানের শেষ দিনে জরিমানা ৯২ হাজার টাকা : ডেঙ্গুর জন্য অতিঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিন দিনের চিরুনি অভিযান শেষ হলো। গতকাল শেষ দিনে ১৮৮টি বাসাবাড়ি ও স্থাপনা পরিদর্শন করতে পেরেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর মধ্যে ১২টি বাসাবাড়ি ও নির্মাণাধীন ভবনে মশার লার্ভা পাওয়ায় ৯২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে মালিকদের।
মন্তব্য করুন