আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম এখন ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। রয়টার্স বলছে, দাম আরও বাড়তে পারে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, দেশের কৃষকদের অর্থ সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়েছে ভারত সরকার। সেইসঙ্গে প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রভাব পড়ছে চাল উৎপাদনে। এ অবস্থায় সরবরাহ ঘাটতিতে চালের দাম আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
বিশ্বব্যাপী চাল রপ্তানির ৪০ শতাংশের বেশি করে ভারত। গত বছর দেশটি ৫ কোটি ৬০ লাখ টন চাল রপ্তানি করেছিল। কিন্তু একদিকে প্রতিকূল আবহাওয়া এবং অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ায় ভারতের চাল রপ্তানি কমে যেতে পারে, আর তাতে অবধারিতভাবে চালের দাম বাড়বে। ভারতের চাল রপ্তানিকারকদের সংগঠন রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (আরইএ) সভাপতি বি ভি কৃষ্ণা রাও জানান, সবচেয়ে কম দামে চাল রপ্তানি করত ভারত। কিন্তু ভারতে কৃষকদের দেওয়া ন্যূনতম মূল্য সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে দেশে চালের দাম বাড়ছে, সেইসঙ্গে অন্যান্য সরবরাহকারীও দাম বাড়াতে শুরু করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, গত জুনে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের দেওয়া ন্যূনতম মূল্য সহায়তার পরিমাণ ৭ শতাংশ বাড়িয়েছে। এতে ভারতের চালের রপ্তানিমূল্য ৯ শতাংশ বেড়েছে। সেই খবরে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চালের রপ্তানিমূল্যও বেড়েছে। বিশ্বের ৩০০ কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। এশিয়া অঞ্চলে পানিভিত্তিক চাষাবাদের ৯০ শতাংশই হচ্ছে এই ধান। কিন্তু এল নিনোর (আবহাওয়া চক্র) কারণে বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাবে।
আশঙ্কার কথা হলো, এসব কিছু ঘটার আগেই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার খাদ্যমূল্য সূচকে চালের দাম এখন ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম—বিশ্বের এই ছয় শীর্ষ চাল উৎপাদক দেশে রেকর্ড পণ্য উৎপাদনের পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয় (ইউএসডিএ)। তা সত্ত্বেও চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। এদিকে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় চালের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে চিনি, মাংস ও ডিমের দাম গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ ছাড়া বেশ কিছু দেশে অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যের দাম কমাতে রপ্তানি কমিয়েছে।
চালের রেকর্ড উৎপাদনের পূর্বাভাস সত্ত্বেও সীমিত সরবরাহের কারণে দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
ইউএসডিএর পূর্বাভাস, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তে বৈশ্বিক চাল মজুতের পরিমাণ ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসতে পারে, যা হতে পারে ১৭ কোটি ২০ লাখ টন। চীন ও ভারতের মতো দেশে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে মজুত কমে গেছে।
আরও বাড়তে পারে দাম
নয়াদিল্লিভিত্তিক এক শস্য ব্যবসায়ী রয়টার্সকে জানিয়েছেন, এল নিনোর কারণে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে চাল উৎপাদন কমতে পারে। বিশ্বের দ্বিতীয় চাল রপ্তানিকারক থাইল্যান্ডে মে মাসে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়নি। এ কারণে দেশটির সরকার কৃষকদের ধান উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। ভারতেও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হচ্ছে। দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, এ কারণে গ্রীষ্মকালীন ধান চাষের পরিমাণ কমেছে ২৬ শতাংশ। বিশ্বের শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ চীনেও মৌসুমের শুরুতে উৎপাদনের সহায়ক পরিবেশ ছিল না। তবে মজুত বেশি থাকার কারণে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য আছে বলে জানিয়েছেন সাংহাই জেসি ইন্টেলিজেন্সের বিশ্লেষক রোজা ওয়াং। ভারতে খাদ্যের দাম সব সময়ই রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই পরিস্থিতিতে ধান চাষের পরিমাণ কমে যাওয়া ক্ষমতাসীন দলের জন্য অশনিসংকেত। আগামী বছর জাতীয় নির্বাচনের আগে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাই চাল রপ্তানি কমাতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ব্যবসায়ীদের মতে, মোদি সরকার গমের উচ্চমূল্য সামলাতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিতে মোটেও কার্পণ্য করবে না। এমন হলে অন্য চাল উৎপাদক দেশগুলোও আন্তর্জাতিক বাজারে চাল সরবরাহে লাগাম টানবে। এতে সরবরাহ ঘাটতিতে বাড়বে চালের দাম। এদিকে এল নিনোর প্রভাবের কথা বিবেচনা করে ইন্দোনেশিয়া গত মাসে ভারত থেকে ১০ লাখ টন চাল আমদানি করেছে। দেশটি সাধারণত থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানি করে।
এই বাস্তবতায় সিঙ্গাপুরভিত্তিক এক ব্যবসায়ী রয়টার্সকে বলেন, গত কয়েক বছরে চালের বাজার রাজত্ব করেছে ক্রেতারা। কিন্তু এল নিনোর কারণে এবার সেখানে বিক্রেতাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
মন্তব্য করুন