যুদ্ধবিরতির পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত উত্তর গাজায় ফিরতে শুরু করেছেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা। দুই বছরের দীর্ঘ ও বিধ্বংসী যুদ্ধ শেষে তারা যখন নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরছেন, তখন চোখে পড়ছে শুধু ভাঙা দেয়াল, পোড়া ঘর, আর ধ্বংস হয়ে যাওয়া জনপদ। সেই ধ্বংসস্তূপকে আঁকড়ে ধরেই নতুন করে জীবন সাজাতে চাইছেন ফিলিস্তিনিরা।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, গাজা শহরের নতুন করে নির্মাণ করতে কতদিন সময় লাগবে? জাতিসংঘের আবাসন অধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি বালাকৃষ্ণ রাজাগোপাল সতর্ক করে বলেছেন, এই বিপর্যয়ের পর গাজাকে পুনর্গঠন করতে কয়েক প্রজন্মের সময় লাগবে।
শনিবার আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাজাগোপাল বলেন, ‘উত্তর গাজায় যারা ফিরে যাচ্ছেন, তারা ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছেন না। যুদ্ধের মানসিক আঘাত এতটাই গভীর যে, পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুধু স্থাপনা নয়, মানুষের মনকেও নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।
তিনি আরও জানান, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার কয়েকটি এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে। এই সুযোগে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজার ৯২ শতাংশ আবাসিক ভবন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।
রাজাগোপাল বলেন, ‘এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, ইসরায়েল যেন অবিলম্বে গাজায় তাঁবু, অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেয়। ইসরায়েল যদি সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের বাধা না তোলে, তাহলে সহায়তা পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
তিনি বলেন, গাজার পুনর্গঠন শুরু করতে হলে প্রথমে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অবকাঠামো যেমন- পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা ও আশ্রয়—পুনঃস্থাপন করতে হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই ভূখণ্ডে এখন তাঁবুই একমাত্র ছায়া।
এই জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ গাজায় বাড়িঘর ধ্বংসের ঘটনাকে ‘ডোমিসাইড’ বা গণআবাস ধ্বংসযজ্ঞ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, পরিকল্পিতভাবে বসতবাড়ি ধ্বংস করে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা এক ধরনের জাতিগত নিধনের কৌশল, যা আন্তর্জাতিক আইনে জাতিহত্যার উপাদান হিসেবে গণ্য হয়।
রাজাগোপাল স্মরণ করিয়ে দেন ১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’র কথা, যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। তার ভাষায়, ‘গাজার সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞ সেই নাকবারই পুনরাবৃত্তি। একটি প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম এভাবেই উচ্ছেদ ও বঞ্চনার উত্তরাধিকার বহন করছে।’
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। বেঁচে থাকা লাখো মানুষ আজ তাঁবুতে, আশ্রয়হীন ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় জীবনযাপন করছে।
বিশেষজ্ঞ রাজাগোপাল বলেন, গাজার পুনর্গঠন শুধু ইট-পাথরের কাজ নয়, এটি ন্যায় ও মানবিকতার প্রশ্ন। যতদিন পর্যন্ত দখলদারিত্ব ও অবরোধের নীতি চলবে, ততদিন গাজার ভবিষ্যৎও ধ্বংসস্তূপেই পড়ে থাকবে।
মন্তব্য করুন