জাকির হোসেন লিটন
প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:২০ এএম
আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৪১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আইন বহাল রেখেই কৌশলী আ.লীগ

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক
আইন বহাল রেখেই কৌশলী আ.লীগ

দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিদ্যমান আইন বহাল রেখেই আপাতত দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তৃণমূলে কোন্দল ও হানাহানি নিরসন, মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ এবং নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর করতে এবারের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় পরবর্তী সময়ে এ সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসতে পারে বলেও আভাস দিয়েছে একাধিক সূত্র।

সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় দলের নেতাকর্মীদের চরম বিভক্তি ও সংঘাতের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কাউকে নৌকা প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি স্থায়ী কোনো ঘোষণা নয়। এ কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন-সংক্রান্ত আইনে আপাতত কোনো সংশোধন করা হচ্ছে না। কারণ, বর্তমান আইনে ‘দলীয়’ এবং ‘নির্দলীয়’ দুই ধরনের প্রার্থিতারই সুযোগ রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন না দিলেও অন্য যে কোনো দল তাদের প্রতীক নিয়ে এই নির্বাচন করতে পারবে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন সংশোধন করতে হলে তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আইন সংশোধনের জন্য প্রথমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে খসড়া তৈরি করতে হবে। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংসহ নানা প্রক্রিয়ার পর মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করে জাতীয় সংসদে পাঠাতে হবে। সেখানে বিল আকারে উপস্থাপন, সংসদীয় কমিটির মতামতসহ চূড়ান্তভাবে পাস করাতে কিছুদিন সময় লাগবে। আগামী ৩০ জানুয়ারি নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হচ্ছে। এর আগে গতকাল বুধবার নির্বাচন কমিশন কুমিল্লা, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের বেশ কিছু নির্বাচনের তপশিলও ঘোষণা করেছে। ফলে আপাতত দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিধান তুলে দেওয়ার সুযোগ কম। সেজন্য বিদ্যমান আইনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবার দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন করবে আওয়ামী লীগ।

কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বেশ কয়েকজন নেতা কালবেলাকে জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন আপাতত সংশোধন করা হচ্ছে না। কারণ, এতে দুই ধরনের সুযোগ রয়েছে। বিরোধী দলগুলোর বর্জনসহ বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে নির্দলীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আবার কখনো প্রয়োজন মনে হলে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ কালবেলাকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রচলিত আইনে দলীয় প্রতীক এবং দলীয় প্রতীক ছাড়া দুভাবেই অংশ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেজন্য আইন সংশোধনের কোনো দরকার নেই। বর্তমান আইনের মধ্য থেকেই নির্বাচনে অংশ নেবে আওয়ামী লীগ।’

২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার আইন সংশোধন করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় নির্বাচন-সংক্রান্ত সব আইনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান যুক্ত করা হয়। সে অনুযায়ী বর্তমানে সব স্তরের স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকেই হচ্ছে। তবে আইনে দলীয় মনোনয়নের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আইনের সে সুযোগ কাজে লাগাতে চান আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। এরই মধ্যে আসন্ন উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। অর্থাৎ কোনো প্রার্থীকে আর নৌকা প্রতীক দেওয়া হবে না। এক্ষেত্রে দলের যে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন। দলের নেতাকর্মীরাও যার যার পছন্দমতো প্রার্থীর পক্ষে ভোট করতে পারবেন। ভোটে অন্য দলগুলোর অংশগ্রহণ বাড়িয়ে নির্বাচন উৎসবমুখর করা এবং দলীয় বিভেদ কমাতেই এমন সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষমতাসীনরা।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, এসব নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করতে আইন সংশোধনের কোনো প্রয়োজন পড়বে না। নির্বাচন কমিশনও মনে করছে, প্রচলিত আইনেই প্রতীকের বাইরে নির্বাচন করা সম্ভব। নির্ধারিত শর্ত পূরণ করে যে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। আবার যে কোনো দল চাইলে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করতে পারবে।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আইন অনুযায়ী আওয়ামী লীগ যদি মনে করে সেখানে দলীয়ভাবে মনোনয়ন দিয়ে দেবে, তাহলে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আবার দল যদি মনে করে, না আমরা এভাবে দলীয় মনোনয়ন কাউকে দেব না, আবার কোথাও কোথাও দেব, কোথাও কোথাও দেব না—দল থেকে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আছে। সেজন্য আইন সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই।’

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। এ নিয়ে অনেক সময় স্থানীয় নেতাদের বিপাকেও পড়তে হচ্ছে। প্রতীক একজনকে দিলে আর একজন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। এতে দলীয় শৃঙ্খলা যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি তৃণমূল রাজনীতিতে বিভেদ-বিভাজনও বাড়ছে। দলীয় প্রতীক বরাদ্দ ঘিরে কোন্দল ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই নিয়ে দলীয় সংসদ সদস্য, জেলা-উপজেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীর মধ্য থেকে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর প্রার্থী চূড়ান্তকরণে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রভাব খাটিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যান দলের অনেক প্রার্থী। এতে ভোট উৎসবে ভাটা পড়ে। সেজন্য এবার দলীয় প্রতীকের বাইরে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে দলের হাইকমান্ড।

এ ছাড়া বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ায় অনেক আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটে উৎসবমুখর অবস্থা দেখা যায়। ফলে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতেও সেই কৌশল নিচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। এতে একদিকে যেমন বিরোধী দলগুলোর স্থানীয় পর্যায়ের নেতারাও ভোটে আসবেন, অন্যদিকে প্রার্থিতা উন্মুক্ত হওয়ায় অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর ভোট নিশ্চিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

২০১৫ সালে আইন সংশোধনের পর ২০১৬ সালের ২২ মার্চ দেশে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন শুরু হয়। এতে স্থানীয় পর্যায়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। তাদের মতে, দলীয় প্রতীককে ঘিরেই স্থানীয় পর্যায়ে শুরু হয়

সংঘাত-সংঘর্ষ-সহিংসতা। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা হয়ে ওঠে রক্তাক্ত। নির্বাচন কেন্দ্র করে নিজ দলের মধ্যে আন্তঃকোন্দল ও রেষারেষি বেড়েছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা কালবেলাকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপিসহ বেশ কিছু দল স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্জন করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া-না দেওয়া খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না। বরং ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক না থাকলেও বিরোধী দলগুলোর স্থানীয় অনেক নেতা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী হতে পারেন। আবার তারা নির্বাচনে অংশ না নিলেও প্রার্থিতা উন্মুক্ত থাকায় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সংগঠনগুলোও বিভিন্ন ফোরামে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের মতে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন চালুর পর থেকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দুর্বল হচ্ছে। আইনগত বাধা না থাকলেও দলমত নির্বিশেষে মানুষ যাদের ভালোবাসে, এমন ভদ্রলোকরা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না। কারণ দলীয় প্রার্থীর দাপটে তাদের জয়ী হওয়ার পথ অনেকটাই রুদ্ধ। দলীয় মনোনয়ন যারা পাবেন, তারাই নির্বাচিত হবেন—এটা এখন প্রতিষ্ঠিত। সরকারদলীয় প্রার্থীদের বেলায় এটা আরও সত্য। সেজন্য দলীয় প্রতীকের বাইরে নির্বাচনের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন তারা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফেসবুকে যে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে মেটা

যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে হত্যায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ, শয্যা সংকটে মেঝেতে সেবা নিচ্ছেন রোগীরা

‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষরিত হবে ১৫ অক্টোবর

এক হওয়া ৫ ব্যাংকের কর্মীদের চাকরি নিয়ে প্রেস সচিবের যে বার্তা

যে কারণে গভীর রাতে স্বামীর কবর জিয়ারত করতে যান খালেদা জিয়া

তারেক রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বটগাছ যমুনায় বিলীন

সকালে খালি পেটে ভুলেও খাবেন না যে ৭ খাবার

আগামীর বাংলাদেশে চাঁদাবাজি মাদক সন্ত্রাস থাকবে না : নজরুল ইসলাম আজাদ

গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ১০ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি

১০

সামিতকে বেঞ্চে রেখেই ক্যাবরেরার একাদশ

১১

যে ৮ ধরনের মানুষের জন্য কফি খাওয়া বিপদজনক

১২

নির্বাচন নিয়ে কনফিউশনে দুই তথাকথিত সিনিয়র সাংবাদিক : প্রেস সচিব

১৩

বজ্রপাত প্রতিরোধে ২০০ তালের চারা রোপণ করল পুলিশ 

১৪

জামায়াত আমিরের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনারের সৌজন্য সাক্ষাৎ

১৫

বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব থেকে ছিটকে গেলেন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা

১৬

আমিরাতে আটক বাকি ২৫ বাংলাদেশি কবে ফিরছেন, জানাল সরকার

১৭

হত্যার পর মা-বাবাকে ঘরের ভেতরে পুঁতে রাখেন ছেলে

১৮

শান্তি রক্ষা মিশন নিয়ে দুঃসংবাদ দিল জাতিসংঘ

১৯

শাবিপ্রবির ২৫ শিক্ষার্থী বহিষ্কার, প্রতিবাদে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন

২০
X