সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল থাকলেও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বুঝেশুনে সামনের দিকে এগোতে চায় বিএনপি। আপাতত রুটিন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের নতুন করে সংগঠিত করার দিকেই মনোযোগ দেবে দলটি। সেইসঙ্গে চলবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিগত দিনের সাফল্য-ব্যর্থতা মূল্যায়ন। এর ভিত্তিতে রোজার পর সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে দলটি। অবশ্য কারাগারে থাকা নেতাকর্মীদের মুক্ত করার ব্যাপারে বিএনপি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে বলে দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন।
সরকার পতনের একদফা সামনে রেখে এক বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করলেও চূড়ান্ত সাফল্য পায়নি বিএনপি। তাদের বর্জনের মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারি দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এদিকে আন্দোলন সফল না হওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে বিএনপি। গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ ২৫ হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি নেতাকর্মীরাও আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। এরই মধ্যে বিভিন্ন মামলায় অনেকের সাজা হয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচনের পর আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতা এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে দলের অভ্যন্তরে আলোচনা শুরু হয়। স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে হাইকমান্ডের এই মূল্যায়ন সভা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে দলটির দুই ধরনের বিশ্লেষণ রয়েছে। একটি হলো, বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ৭ জানুয়ারি ভোট বর্জন করেছে। এটা আন্দোলনের এক ধরনের সফলতা। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির নৈতিক বিজয় হয়েছে। অন্য বিশ্লেষণটি হচ্ছে, রাজপথে দীর্ঘ আন্দোলন করেও চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করা যায়নি। কারণ সরকারের পতন হয়নি, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিও আদায় হয়নি। এ জন্য সাংগঠনিকভাবে তাদের কী ধরনের দুর্বলতা ছিল, আন্দোলন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত নেতাদের কোনো ব্যর্থতা ছিল কি না, অঙ্গসংগঠনগুলো কেমন দায়িত্ব পালন করেছে—দলের ভেতরে এখনো সেসবের মূল্যায়ন চলছে।
জানা গেছে, বিএনপির হাইকমান্ড এখনো দল, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পুনর্গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে রোজার পর থেকে পুনর্গঠন কাজে হাত দেওয়া হতে পারে বলে দলে আলোচনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে একেবারে জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ স্তরগুলো পুনর্গঠন করা হবে। আন্দোলনে যারা ছিলেন না, কর্মীদের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ ছিল না—পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় তাদের বাদ দেওয়া হতে পারে। কারণ প্রাথমিক মূল্যায়নে সরকারবিরোধী আন্দোলনে অনেক নেতার ভূমিকা, বিশেষ করে অঙ্গসংগঠনের পারফরম্যান্সে ক্ষুব্ধ বিএনপির হাইকমান্ড। দলটি মনে করছে, আন্দোলনে অঙ্গসংগঠনগুলো রাজপথে প্রত্যাশিত সক্ষমতা দেখাতে পারেনি।
এদিকে নির্বাচনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে দলীয় বিভিন্ন ফোরামে আলোচনার পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদেরও মতামত নিচ্ছে বিএনপি। প্রাথমিক আলোচনায় সংসদ বাতিল, একদফা দাবি এবং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে যুগপৎ আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সামনে মিত্রদের সঙ্গে আরও আলোচনা করবে বিএনপি। এ ছাড়া আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা ও ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে যুগপতের শরিকরাও নিজেরা মূল্যায়ন বৈঠক করছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর গত ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি ঢাকাসহ দেশব্যাপী কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদ বাতিল, একদফা দাবি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে এই কর্মসূচি পালিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ভোটের পর মাঠে নামে বিএনপি। এ ছাড়া সংসদ অধিবেশন শুরুর দিন গত ৩০ জানুয়ারি সংসদ বাতিল এবং একদফা দাবিতে ঢাকাসহ দেশব্যাপী একই কর্মসূচি ছিল দলটির। তবে পুলিশি বাধার মুখে অধিকাংশ স্থানে কালো পতাকা মিছিল করতে পারেনি বিএনপি।
জানা গেছে, আগামীতে যুগপৎ আন্দোলনের পাশাপাশি আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচিও পালন করবে বিএনপি ও মিত্র দলগুলো। তবে ব্যাপক ভিত্তিতে নয়, স্বল্প পরিসরে থেমে থেমে কর্মসূচি নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন চলবে। রোজার মাস সামনে রেখে এই আন্দোলনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ইস্যুটি গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। দিবসভিত্তিক কর্মসূচির সঙ্গে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আন্দোলন এগিয়ে নেবে বিএনপি ও শরিকরা।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতা মূল্যায়নের কাজ চলমান রয়েছে। একই সঙ্গে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্দোলনও অব্যাহত থাকবে, তবে তা সীমিত পরিসরে। তাদের এখন মূল লক্ষ্য, দলের কারাবন্দি নেতাকর্মীদের জামিনে মুক্ত করা। জেলা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতারা কারামুক্ত হচ্ছেন। তাদের প্রত্যাশা, আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রমজান শুরুর আগেই বাকি নেতারা মুক্তি পাবেন। তারা আরও জানান, রমজানে ইফতারকেন্দ্রিক রাজনীতিতে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীরা নতুন করে সংগঠিত হবেন। আর আন্দোলনে নেতাদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শেষে সংগঠন পুনর্গঠনের কাজে মনোযোগ দেওয়া হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা একটা যুগপৎ আন্দোলনে আছি। জোটবদ্ধ আন্দোলনে সিদ্ধান্ত তো জোটে আলোচনা করেই নিতে হয়। আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি প্রণয়নে আমাদের আলোচনা চলছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্দোলনে রয়েছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’