পাকিস্তানে ৮ ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে নানা নাটকীয়তা চলছে। কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকার গঠনের ব্যাপক তোড়জোড়ের মধ্যে ওই ভোটে কারচুপির অভিযোগে গতকাল শনিবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ করেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পিটিআই। পাশাপাশি কয়েকটি বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ ও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে তারা। মূলত সরকার গঠন চেষ্টার পাশাপাশি আন্দোলনের মাঠে থেকে দলটি সমাধানের পথ খুঁজছে।
এদিকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন নিয়ে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে অনিশ্চয়তা চলার পর এ ইস্যুতে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) মধ্যে যখন সমঝোতা চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন পিএমএল-এনের শীর্ষ নেতারা। যদিও ওই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছেন পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা। পিএমএল-এন ও পিপিপি সমঝোতা করায় তারা সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। ভোটের দিন থেকে এ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, জালিয়াতি, ফল পাল্টে দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ তুলছে পিটিআইসহ কয়েকটি দল। এমনকি এক নির্বাচিত প্রার্থীও তাকে অনিয়ম করে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে আসন ছেড়েছেন। শুধু কি তাই? রাওয়ালপিন্ডি শহরে ভোট জালিয়াতির সঙ্গে নিজের জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়ে গতকাল পদত্যাগ করেছেন ওই ডিভিশনের কমিশনার লিয়াকত আলি চাতা। একই সঙ্গে তিনি নিজের ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ জড়িতদের বিচার চেয়েছেন। এমন টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে ইমরান খান জানিয়েছেন, যদি তার দল আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তিনি কোনো রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেবেন না। বরং সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে পাকিস্তানের উন্নতির জন্য কাজ করবেন।
এর আগে শুক্রবার পিটিআই নেতা সাবেক স্পিকার আসাদ কায়সার জামায়াত-ই-ইসলামী, কওমি ওয়াতান পার্টির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাদের ভোটে কারচুপির আন্দোলনে সমর্থনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল পাখতুনখোয়া মিলি আওয়ামী পার্টির সঙ্গে বসেন তিনি।
দেশব্যাপী আন্দোলনের চালিয়ে যাওয়ার জন্য দলের প্রধান ইমরান তাকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দিয়েছেন।
আসাদ কায়সার ভোটে কারচুপির প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন।
দলীয় সিদ্ধান্তের পর সংবাদ সম্মেলনে পিটিআই নেতা ব্যারিস্টার সাইফ সংবাদমাধ্যম ডনকে জানিয়েছেন, সরকার গঠনের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তা না হলে কেন্দ্রে ও পাঞ্জাবে বিরোধী দলের আসনে বসবে দল। এ ছাড়া খায়বার পাখতুনখোওয়ায় সরকার গঠন করবে পিটিআই।
কিউডব্লিউপির প্রধান আফতাব শেরপাওর সঙ্গে বৈঠক করেছেন আসাদ কায়সার। পরে শেরপাও বলেন, এই বিতর্কিত নির্বাচন পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনবে না। সাবেক স্পিকার আসাদ বলেন, জালিয়াতির নির্বাচনের প্রতিবাদে দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবে পিটিআই। এতে দেশবাসী অংশ নেবে। দেশব্যাপী এ আন্দোলনের মধ্যে লাহোর পিটিআই নেতা সালমান আকরাম রাজাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে দল।
এরই মধ্যে রাওয়ালপিন্ডি ডিভিশনের কমিশনের অভিযোগের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দল এ ঘটনার তদন্তের দাবি জানিয়েছে। এ ঘটনাকে পিএমএল-এন রাজনৈতিক অভিযোগ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনায় সন্দেহ প্রকাশ করেছে পিপিপি। পিটিআই বলছে, এগুলো ভোট কারচুপির প্রমাণ।
ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার অভিযোগের পর ওই কমিশনারের বিরুদ্ধে জিডি করা হয়েছে। ঘটনাটিকে ভিত্তিহীন আখ্যা দিয়ে গুরুত্ব না দিতে বলেছেন দেশটির প্রধান বিচারপতি।
এদিকে পিএমএল-এনের জ্যেষ্ঠ নেতাদের একাংশের ভাষ্য, পাকিস্তান এখন সার্বিকভাবে খুবই টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে এবং এখন সরকার গঠনের মানে হলো ‘স্বেচ্ছায় মাথায় কাঁটার মুকুট’ পরা। পিএমএল-এনের অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা খাজা সাদ রফিক দলের এ অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে শুক্রবার খাজা সাদ রফিক বলেন, ‘পিটিআই যেহেতু সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে; তাই তাদেরই উচিত পিপিপির সঙ্গে জোট করে সরকার গঠন করা। দেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে এই মুহূর্তে সরকার গঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার মানে হলো নিজের মুকুটকে কাঁটা দিয়ে সজ্জিত করা এবং আমরা মনে করি, পিএমএল-এনের এমন কোনো ইচ্ছে নেই।’
এর আগে শুক্রবার রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করতে যান পিটিআইর জ্যেষ্ঠ নেতা আলী মুহাম্মদ খান। তখন তাকে ইমরান খান বলেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে রাজনৈতিক বিরোধীদের তিনি ক্ষমা করে দেবেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, ইমরান খান তাকে বলেছেন, পাকিস্তানকে এগিয়ে নিতে হলে একটি ন্যায় ও সমন্বয়সাধন কমিটি গঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে আলাদা তিনটি মামলায় পিটিআই প্রধানকে কিছুদিন আগে দেওয়া ৩১ বছরের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন ইমরান। শুক্রবার এ তথ্য জানিয়েছেন তার আইনজীবী। এ ছাড়া বন্দি থাকা তার স্ত্রী বুশরা বিবির স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি হয়েছে এবং বর্তমানে তিনি জীবন ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে দাবি করেছেন বুশরা বিবির ছোট বোন মরিয়ম রিয়াজ ওয়াত্তু। তার অভিযোগ, গৃহবন্দি বুশরা বিবির স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য কোনো চিকিৎসককে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
আলোচিত তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় ইমরানের সঙ্গে বুশরা বিবিও ১৪ বছর কারাবাসের সাজা পেয়েছেন। রাজধানী ইসলামাবাদের আবাসিক এলাকা বানি গালায় নিজেদের বাসভবনে গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন তিনি। সূত্র: দ্য ডন, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, জিওটিভি।