বসন্তের বৃক্ষশোভিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে জায়গায় এখন গাছে গাছে উঁকি দিচ্ছে সবুজ কুঁড়ি, একাত্তরের ৭ মার্চ সেখানেই অঙ্কুরিত হয়েছিল আজকের বাংলাদেশ। একাত্তরের এই দিনে ৭ মার্চ মধ্যাহ্নের পর সেখানে ছিল শুধু মানুষ আর মানুষ। লাঠি হাতে প্রতিবাদী মানুষ, শহরের মানুষ, গ্রামের মানুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব, বৃদ্ধ-যুবাÑসর্বস্তরের মানুষ। সেদিন আজকের এই নামও ছিল না, ছিল রেসকোর্স ময়দান। সেদিন প্রতিটি মানুষ ও মিছিলের গন্তব্য ছিল এই উদ্যান।
সত্তরের সাধারণ নির্বাচন এবং এর পরের ঘটনা প্রবাহে ৭ মার্চের জনসভাটি পরিণত হয়েছিল বাঙালির মিলন মোহনায়। মুক্তিকামী মানুষের প্রত্যাশাকে ধারণ করে সেই ময়দানে লাখো জনতার সামনে দাঁড়িয়ে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন তার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ঘোষণাটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নয়। কিন্তু এটাকেই বিবেচনা করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ঘোষণা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের তো বটেই, আজো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমাদের উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করে। অসম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেন। পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের জন্যই যেন অধীর অপেক্ষায় ছিল পুরো জাতি। তাই তার দিকনির্দেশনামূলক ভাষণের পর ২৫ মার্চ কালরাতে যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নেমে এলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র হামলা, তখন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাঙালির এতটুকু দেরি হয়নি।
এই দিনে বঙ্গবন্ধু মাত্র ২০ মিনিটের ভাষণে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশসহ সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণের দাবি উত্থাপন করেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না।
২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’
এই ঐতিহাসিক ভাষণ ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ সম্প্রচার না করায় বাঙালি কর্মচারীরা এদিন কাজ বন্ধ করে দেয়, ফলে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার করা হলেও এ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ফলে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান সম্প্রচারও বন্ধ হয়ে যায়। গভীর রাতে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীদের সঙ্গে সামরিক কর্তৃপক্ষের দীর্ঘ আলোচনার পরদিন ৮ মার্চ (সোমবার) সকাল ৬টা থেকে রেডিও সম্প্রচার শুরু এবং সাড়ে ৮টায় রেসকোর্সের বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণী ঢাকাসহ দেশের সব কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত হয়।
অন্যদিকে ‘স্বাধীন বাংলার’ দাবিতে এদিন (৭ মার্চ, রোববার) ব্রিটেন প্রবাসী প্রায় ১০ হাজার বাঙালি লন্ডনস্থ পাকিস্তানি হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভকারীরা শত শত ব্যানার, প্ল্যাকার্ডসহ ‘ভুট্টোর বিচার চাই’ বলে স্লোগান দেয়। বিক্ষোভ চলাকালে পাকিস্তানি হাইকমিশনার অফিসের বাইরে এলে তার প্রতি ঢিল নিক্ষেপ করা হয় এবং এতে তিনি আহত হন।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক সে ভাষণ যে শুধু বাঙালির মুক্তির সনদ তা নয়, যুগে যুগে সারা বিশ্বে নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের জন্য শোষণ ও বঞ্চনা থেকের মুক্তির ইশতেহার। আর এজন্য বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিকবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির অধীনে আন্তর্জাতিক তালিকায় (ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার) মোট ৭৮টি দলিলের মধ্য ৪৮ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের স্থান দেয়। দেশে দেশে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে অনূদিত হচ্ছে প্রেরণাদায়ী বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ।
এদিকে, প্রতি বছরের মতো এবারও দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন ৭ মার্চ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।
দিনটি উদযাপনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভোর সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। দিবসটি উপলক্ষে আজ বিকেল ৪টায় তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে গৃহীত দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সব স্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।