চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদে মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির হয়। তাপপ্রবাহে প্রাণিকুলে থাকে অস্বস্তি। চৈত্রের সেই রুদ্ররূপ আর নেই। খরার বদলে চৈত্র এখন মেঘলা আবহাওয়া, বৃষ্টিবাদল, সকালে কুয়াশা, দিনে গরম, রাতে ঠান্ডা। কয়েক বছর ধরে চৈত্র যেন পেয়েছে নতুন রূপ। আবহাওয়ার হেঁয়ালি আচরণে গ্রীষ্মে থাবা বসাচ্ছে শীত, ঝোড়ো হাওয়া বইছে শীতে কিংবা বর্ষাকালেও ঘটছে বজ্রপাত আর শিলাবৃষ্টি। গবেষকদের মতে, আবহাওয়ার এই রূপ বদল ঘটছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে। মৌসুমভিত্তিক আবহাওয়ার ধরন দ্রুত পাল্টাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা দেশের ষড়ঋতুর ওপর ভালোভাবেই জেঁকে বসেছে। এর প্রভাব পড়ছে জীবন ও প্রকৃতিতে। ঝুঁকিতে পড়ছে কৃষি, স্বাস্থ্য, বাড়ছে দুর্যোগ, বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ।
কয়েক বছর ধরে শীত থাকছে ফাল্গুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কিন্তু তার পরই তাপমাত্রা চড়ে যাচ্ছে ৩৫ ডিগ্রির ওপরে। দখিনা বাতাসে থাকছে উষ্ণতা। আবার শীতের পরই লাফ দিয়ে চলে আসছে গ্রীষ্ম। দেশের এক এলাকায় বৃষ্টি তো আরেক এলাকায় থাকছে প্রচণ্ড গরম। গত চার দশকের আবহাওয়া পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশে এখন বর্ষার সময়ও তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বর্ষা আসার সময় পাল্টে যাচ্ছে, বর্ষা বিদায়ও নিচ্ছে দেরিতে। শুধু বর্ষা নয়, শীতেও বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা। মেঘাচ্ছন্ন দিনের পরিমাণ বাড়ছে। এর ফলে শীতের দিনে তাপ বাড়লেও শীতের তীব্রতা অনুভূত হচ্ছে। ডেঙ্গুর মতো কীটপতঙ্গবাহিত নানা রোগ দেশে বেড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে গত ৪৩ বছরের আবহাওয়ার নানা পরিবর্তনের চিত্র উঠে এসেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, আবহাওয়ার এ বৈরী আচরণ চলছে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বজুড়ে। এমন প্রেক্ষাপটে আজ শনিবার বিশ্ব আবহাওয়া দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।
সাধারণত মে মাসের শেষের দিক থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকা দিয়ে বাংলাদেশের মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করে। আর তা চলে যেতে থাকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। গবেষণার তথ্য বলছে, ২০০০ সালের পর থেকে কখনো কখনো বর্ষা আসতে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে। গত বছর বর্ষা এসেছে ৮ জুন। একইভাবে বর্ষা যাচ্ছেও দেরি করে। গত ১০ বছরে কখনো কখনো ২৩ অক্টোবর পর্যন্তও মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ছিল। অর্থাৎ তখনো বৃষ্টি হতো।
ঢাকায় বেশির ভাগ শৈত্যপ্রবাহ হতো জানুয়ারি মাসে। তবে গত শতকের ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিক থেকে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। ঢাকায় সার্বিকভাবে শৈত্যপ্রবাহ কমে গেছে। রাজশাহীতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতো। ২০০৬ সালের পর এ প্রবণতা কমে গেছে। শীত আসছে দেরিতে। ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারিতে শৈত্যপ্রবাহ কমলেও বেড়েছে জানুয়ারিতে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে তাপপ্রবাহ শুরু হতো মার্চের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে। তবে ১৯৯৭ সালের পর থেকে এতে ভিন্নতা দেখা গেছে। এখন দেখা গেছে, এটিও পিছিয়ে যাচ্ছে। এপ্রিল ও মে মাসজুড়েই তাপপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে। এমনকি ২০১০ সালের পর থেকে বর্ষা মৌসুমেও তাপপ্রবাহ বেড়েছে। উত্তর-পশ্চিমের জনপদ রাজশাহীতে দেখা গেছে, ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে বর্ষা মৌসুমে দুই থেকে তিনটি করে তাপপ্রবাহ বয়ে যেত। সেটি ২০১০ থেকে ২০২০ সালের দিকে আট থেকে ১২টি পর্যন্ত হয়ে গেছে। রংপুর, খুলনাসহ প্রায় সব বিভাগে বর্ষা মৌসুমেও তাপপ্রবাহের সংখ্যা বেড়েছে। তবে চট্টগ্রামে তাপপ্রবাহের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম।
ঢাকার তাপমাত্রার ক্ষেত্রে ৪০ বছরে দেখা গেছে প্রাক-বর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা-পরবর্তী তিন সময়েই প্রতি দশকেই তাপমাত্রা সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৯, শূন্য দশমিক ৩৩ এবং শূন্য দশমিক ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। শুধু শীতকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কমে গেছে শূন্য দশমিক ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেখা গেছে, ঢাকাসহ দেশের আট বিভাগেই বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেড়েছে। এর মধ্যে খরাপ্রবণ রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রতি দশকে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে। বৃষ্টিবহুল সিলেটেও একই মাত্রা তাপমাত্রা বেড়েছে। ঢাকা, রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগে প্রতি দশকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন ফাতিমা আকতার বলেন, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার প্রভাব প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছি। আমাদের কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। ভবিষ্যতে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা, অবকাঠামো আরও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাব এখন বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে দেশে। তাপপ্রবাহের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্ষা আসার সময় পাল্টেছে। বিলম্ব হচ্ছে চলে যেতেও। শুধু বর্ষা নয়, শীত বা গ্রীষ্মেও বেড়ে যাচ্ছে তাপ। মেঘাচ্ছন্ন দিনের পরিমাণ বাড়ছে। তাতে শীতের দিন তাপ বাড়লেও শীতের তীব্রতার অনুভূতি হচ্ছে বেশি মাত্রায়। এর সঙ্গে বাড়ছে বায়ুদূষণ।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো তাপপ্রবাহের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে। সারা দেশেই এটি বাড়ছে। শীতেও স্থানীয়ভাবে আবহাওয়ার বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শীতকালে ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে বেশি। এ তাপপ্রবাহ ও শৈত্যপ্রবাহের প্রভাব পড়বে কৃষিতে। সেচের জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খরচ বাড়বে; এসি লাগবে বেশি। সাধারণত তাপপ্রবাহ দেখা যেত গ্রীষ্মকালে—এপ্রিল ও মে মাসে। এখন অক্টোবর পর্যন্ত চলে গেছে। আগে গ্রীষ্মকালে যে তাপপ্রবাহ হতো, গত ১২ বছর থেকে দেখা যাচ্ছে, এটা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। শুধু গ্রীষ্মকালে না, বর্ষাকালেও হচ্ছে। তিনি বলেন, ২০২৩ সালের মতো এ বছরও তাপপ্রবাহ আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি প্রকট। ২০২৩ সাল ছিল উষ্ণতম বছর, গত বছর দীর্ঘ সময় হিটওয়েভ ছিল। জুন মাসে দুই সপ্তাহ ধরে হিটওয়েভ ছিল। ওই সময় দেশের কয়েক জায়গায় ৪০ ডিগ্রির ওপরে তাপমাত্রা ছিল। এই ধরনের হিট ওয়েভ কন্ডিশন ২০২৪ সালেও আসার সম্ভাবনা প্রকট। গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দি এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্সের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চরম আবহাওয়া ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মানুষের জীবন, জীবিকা ও স্বাস্থ্যের ওপর। ৬৫ বছর কিংবা এর বেশি বয়সীদের মধ্যে তাপজনিত মৃত্যু ১৪৮ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ১৪৩০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, বন্যা ও খরার মতো ১৮৫টি চরম আবহাওয়ার ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে।
প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে—খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা তরুণ বা বয়স্ক জনগোষ্ঠী উচ্চতাপ ও তাপপ্রবাহের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বায়ুদূষণেও বাংলাদেশ নিয়মিতই শীর্ষে থাকছে। দূষিত বায়ুর কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ২০১৯ সালের ১ লাখ ১ হাজার ৫০০ জন থেকে ২০২০ সালে ১ লাখ ১২ হাজার ৭০০ জনে ঠেকেছে। ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শুধু ঢাকাতেই বায়ুদূষণে ২৪ হাজার মানুষ অকালে মারা গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি বৃষ্টি আর তাপমাত্রাজনিত কারণে ডেঙ্গুর মতো রোগের প্রাদুর্ভাব আরও বাড়তে পারে। কারণ, এ ধরনের আবহাওয়া মশার বংশবিস্তারের জন্য অনুকূল। জলবায়ু পরিবর্তন মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলছে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, স্থানীয় তাপপ্রবাহের পেছনের চালিকাশক্তিগুলো বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাকেও প্রভাবিত করছে। এ কারণে তাপপ্রবাহের পরিমাণ, তীব্রতা ও মাত্রা বাড়ছে। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে তাপমাত্রা ও বায়ুদূষণ উভয়ই বাড়ছে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য সেটি একটি বহুমুখী ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
গত বছর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে ১.২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই বিনিয়োগ করলে ১১.৬ বিলিয়ন ডলারের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।