কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:০২ এএম
আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিপর্যয়ের মুখে দেশের কৃষি খাত

তাপপ্রবাহ
বিপর্যয়ের মুখে দেশের কৃষি খাত

দুই সপ্তাহ ধরে সারা দেশে বইছে তাপপ্রবাহ। এর মধ্যে কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। চলতি মাসের বাকি দিনগুলোতে তাপমাত্রা আরও বাড়বে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। আগে যেখানে গড়ে তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি, সেখানে এখন ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। তীব্র তাপপ্রবাহে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের কৃষি খাত। টানা তাপপ্রবাহের কারণে দেশের অধিকাংশ এলাকায় ফসলি জমি শুকিয়ে ধান, পাট, বিভিন্ন ধরনের সবজি ক্ষেত নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ঈশ্বরদী, নওগাঁসহ বেশ কয়েকটি জেলায় অতিরিক্ত গরমে আম ও লিচুর গুটি ঝরে পড়ছে। ফলে এবার মৌসুমি ফল আম ও লিচুর ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষিরা। সারা দেশ থেকে কালবেলার প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান তাপপ্রবাহের কারণে ধানের তেমন ক্ষতি হবে না।

তাদের বক্তব্য এরই মধ্যে হাওরের অর্ধেকেরও বেশি বোরো ধান কাটা হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে বোরো ধান কাটার সময় হয়ে এসেছে। এই সময় সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না। তবে সবজি জাতীয় ফসলের ক্ষতি কিছুটা হতে পারে। এ ছাড়া মৌসুমি ফল যেমন আম, লিচুর ফলনে কিছুটা ক্ষতি হবে। এরই মধ্যে অধিদপ্তর থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে ধান, সবজি, মৌসুমি ফলের ফলন রক্ষায় চাষিদের কী কী পরামর্শ দিতে হবে, সে সম্পর্কে জানানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও অধিদপ্তরে এ-সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) মো. আনোয়ার হোসেন খান এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, চলমান তাপপ্রবাহে ফসলের কিছুটা ক্ষতি হবে, এটা স্বাভাবিক। তবে এই ক্ষতিটা হবে খুবই অল্প। এখন বোরোর সময়। হাওরের ধান ৫৬ শতাংশ কাটা হয়ে গেছে। সেখানে ফলনও ভালো হয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে হাওরের সব ধান কাটা হয়ে যাবে। এ ছাড়া অন্যান্য জেলার বোরো ধান কাটার সময় হয়ে এসেছে। সপ্তাহ দুয়েক পর কাটা হবে। এই শেষ সময়ে সেচের দরকার হয় না। ফলে তাপপ্রবাহে ধানের তেমন ক্ষতি হবে না। তবে সবজির ফলন কম হবে। পাশাপাশি অতিরিক্ত গরমের কারণে আম ও লিচুর ফলন কম হবে। তবে গুটি ঝরে পড়া কমাতে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছেন।

বগুড়া ব্যুরো জানায়, তাপপ্রবাহের কারণে মাঠে থাকা বোরো ধান নিয়ে শঙ্কায় আছেন কৃষকরা। একই সঙ্গে টানা তাপপ্রবাহের কারণে মরিচ, কচু, ভুট্টা, কলা, করলা, পটোলসহ বিভিন্ন সবজি ও ফসল নষ্ট হওয়ার উপক্রম। কৃষি বিভাগও বলছে, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির বেশি হলে ধান চিটা হয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ধানক্ষেতে সব সময় পর্যাপ্ত পানি রাখার পরামর্শ দিয়েছে কৃষি বিভাগ। চলতি মৌসুমে বগুড়া জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। এই পরিমাণ জমিতে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৪৩২ মেট্রিক টন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, তাপদাহের কবলে পড়েছে আমের গুটি। এতে ব্যাহত হবে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান অর্থকরী ফসল আম। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে আমের গুটি ঝরে পড়া নিয়ে শঙ্কায় বাগানের মালিক ও ব্যবসায়ীরা। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এতে আমগাছ রয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮২৫টি। এবার জেলার আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার টন।

গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি জানান, রাজবাড়ীতে তীব্র তাপপ্রবাহ ও অতিরিক্ত খরায় পাট চাষ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন চাষিরা। একই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। শ্যালো মেশিনেও উঠছে না পানি। চাষিরা জানান, অতিরিক্ত খরায় ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির। তাপপ্রবাহ বেশি হওয়ায় বিগত সময়ের তুলনায় জমিতে সেচ লাগছে বেশি। সকালে পানি দিলে বিকেলের আগেই শুকিয়ে যাচ্ছে। দিনে ৪-৫ বার সেচ দিয়েও কাজ হচ্ছে না। পানির অভাবে পাট বেড়ে উঠছে না। যে কারণে এবার ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষিরা। জেলার পাঁচ উপজেলায় কমবেশি পাট চাষ হলেও সবচেয়ে বেশি চাষ হয় বালিয়াকান্দি ও রাজবাড়ী সদর উপজেলায়।

গুরুদাসপুর (নাটোর) প্রতিনিধি জানান, লিচুখ্যাত নাটোর জেলার গুরুদাসপুরের বাগানগুলোতে এ বছর নেই লিচু। শিলাবৃষ্টি আর তাপপ্রবাহের কারণে ঝরে পড়েছে লিচুর মুকুল। প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণে লিচুনির্ভর চাষিরা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। এ অবস্থা মোকাবিলায় লিচু রক্ষায় বাড়তি সেচ ব্যবস্থাসহ সব ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। উপজেলার ৪১০ হেক্টর জমিতে ৫৭০টি লিচু বাগান রয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুনর রশিদ জানান, এ বছর শিলাবৃষ্টি আর খরতাপের প্রভাবে উৎপাদন অর্ধেক নেমে আসতে পারে।

ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি জানান, ঈশ্বরদীতেও প্রচণ্ড খরা ও তাপপ্রবাহে লিচুর গুটি ঝরে যাচ্ছে। ফলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন লিচুচাষিরা। দেশি লিচু হিসেবে পরিচিত মোজাফফরপুরী জাতের লিচুর গুটি বেশি ঝরছে। জাতীয় পদক প্রাপ্ত লিচুচাষি আব্দুল জলিল কিতাব মণ্ডল ওরফে লিচু কিতাব বলেন, রাতে ও সকালে পানি ও ওষুধ স্প্রে করেও গুটি ঝরা ঠেকানো যাচ্ছে না।

মেলান্দহ (জামালপুর) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার বোরো চাষিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। মাঠের পর মাঠজুড়ে সেচযন্ত্র থাকলেও লোডশেডিংয়ে নাকাল কৃষকরা। কষ্ট করে সেচ দেওয়া পানিও জমিতে বেশিক্ষণ থাকছে না। এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। এবার উপজেলায় বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ হাজার ২৫০ হেক্টর। কিন্তু চাষ হয়েছে ২০ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে।

মনিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার ভবদহের সবচেয়ে জলাবদ্ধ এলাকা হচ্ছে বিল বোকড় ও বিল কেদারিয়া। এই দুই বিলে বোরো আবাদে বাম্পার ফলন হয়েছে। শতকরা ৮০ শতাংশ জমির ধান কাটার উপযোগী হয়েছে। এখন গোলায় তোলার পালা। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রেখা মণ্ডল জানান, এ বছর বিল কেদারিয়ায় মোট ৫৮০ হেক্টর জমির মধ্যে ৫১০ হেক্টর এবং বিল বোকড়ে মোট ১ হাজার ৩২০ হেক্টর জমির মধ্যে ৭৩০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে।

নিয়ামতপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর নিয়ামতপুরে সপ্তাহখানেক পর বোরো ধান কাটা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাওয়ায় হিটশকে বোরো ধানের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষক। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, অধিকাংশ এলাকায় ধান পেকে ওঠায় তাপমাত্রা বাড়লেও ধানের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। ক্ষতি থেকে ধান রক্ষার জন্য জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখার পরামর্শ দিয়েছে কৃষি বিভাগ। চলতি মৌসুমে উপজেলার আটটি ইউনিয়নে বোরো আবাদ চাষাবাদ হয়েছে ২৩ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমিতে।

দুর্গাপুর (রাজশাহী) প্রতিনিধি জানান, আমের শহরে দিনের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। এতে করে বোঁটার রস শুকিয়ে ঝরে পড়ছে আমের গুটি। পানি দিয়ে ও নানা পদ্ধতি অবলম্বন করেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না। চাষিদের মতে, এরই মধ্যে অনেক বাগানে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ আমের গুটি ঝরে গেছে। আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর এসব উপজেলার আমের বাগানগুলোয় মুকুল অনেক কম এসেছে।

দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, তাপপ্রবাহের কারণে পুড়ে যাচ্ছে লিচুর মুকুল, ঝরে পড়ছে গুটি। এ অবস্থায় বাগানে সেচসহ পরিচর্যা করে গাছে লিচু রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন কৃষকরা। মাসিমপুর খোয়াড়ের মোড় এলাকার লিচুচাষি আমজাদ মোল্লা বলেন, তার বাগানের লিচু গাছে প্রচুর মুকুল এসেছিল। এ কারণে এবার বেশ লাভের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রচণ্ড গরমের কারণে পুড়ে গেছে অনেক মুকুল। এখন ঝরে পড়ছে লিচুর গুটি। শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচ দিয়ে লিচুর গুটি ঝরে পড়া রোধ করার চেষ্টা করছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মোস্তাফিজ-পাথিরানা ছাড়াই চেন্নাইয়ের জয়

তাপপ্রবাহে কী করতে হবে, জানিয়ে নির্দেশিকা প্রকাশ

ভোট বর্জনে কৃষক দলের লিফলেট বিতরণ

প্রেমিকের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রী

ব্যাংক লুটের টাকায় বিদেশে সেকেন্ড হোম করা হয়েছে : আমিনুল হক 

শেখ হাসিনা বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন : ড. সেলিম মাহমুদ 

ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

সৈকত সরকারি কলেজ / আইন ভেঙে ‘চেয়ারম্যানগিরি’ করছেন কলেজের শিক্ষক

সুন্দরবনের আগুন নেভাতে বিমানবাহিনী

ঢাবির আইবিএ গ্র্যাজুয়েশন-২০২৪ অনুষ্ঠিত

১০

ঢাবিতে টেকসই উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ শীর্ষক গোলটেবিল সভা 

১১

জনগণই সরকার ও নেতৃত্ব নির্বাচন করবে : সাইফুল হক

১২

সরিষাবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করল ইসি

১৩

সুপারস্টার রজনীকান্তের জীবনের অজানা অধ্যায়

১৪

ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক

১৫

হানিমুনে কোথায় গেলেন অনুপম-প্রশ্মিতা

১৬

ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে চাঁদা দাবি, পুলিশ কর্মকর্তা অবরুদ্ধ

১৭

তিন হাজার কনটেন্ট সরাতে গুগলকে অনুরোধ বাংলাদেশের

১৮

নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে পাকিস্তানের নির্যাতনের কথা : মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী 

১৯

প্রয়োজনে আবারও শাপলা চত্বরে কর্মসূচি : হেফাজতে ইসলাম

২০
*/ ?>
X