দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তার কালো মেঘ সরে গিয়ে যখন গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, ঠিক সে সময় চুক্তি নিয়ে বেঁকে বসেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। মিশরের রাজধানী কায়রোতে যে আলোচনা চলছে, সেখান থেকে একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেওয়া হয় গাজার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসকে। হামাস চুক্তিতে রাজি হওয়ার পর গাজাজুড়ে উল্লাসও শুরু হয়। সোমবার মধ্যরাতে হামাসের পক্ষ থেকে দেওয়া সেই বার্তা গাজা উপত্যকাজুড়ে স্বস্তি নিয়ে আসে। কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সেই চুক্তিতে রাজি না হওয়ায় গাজার মানুষের স্বস্তি হাওয়ায় মিলে যায়। ইসরায়েল বলছে, এর শর্তগুলো তাদের দাবি অনুযায়ী হয়নি, তাই তারা রাফাহতে সামরিক অভিযান নিয়ে এগিয়ে যাবে। পাশাপাশি চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সোমবার মধ্যরাতে গাজা ও মিশরের সীমান্তবর্তী রাফাহ ক্রসিং ইসরায়েল আকস্মিকভাবে দখলে নেওয়ার পর এ যুদ্ধবিরতি চুক্তি আরও বেশি অনিশ্চয়তা পড়েছে। সেইসঙ্গে রাফাহজুড়ে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে জার্মানি, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গতকাল ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যুদ্ধ থামাতে ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার জন্য প্রভাবশালী দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন। খবর বিবিসি ও আলজাজিরার।
গাজায় যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে মিশরের কায়রোতে কয়েক দিন ধরে আলোচনা চলছে। সেখান থেকে হামাসকে যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস সোমবার এক বিবৃতিতে বলে, তাদের প্রধান নেতা ইসমাইল হানিয়া কাতারের প্রধানমন্ত্রী এবং মিশরের গোয়েন্দা প্রধানকে তাদের তিন দফার এ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। সাত মাস ধরে চলা গাজা যুদ্ধের এমন এক সময় এ অগ্রগতি ঘটল যখন ইসরায়েলি বাহিনী গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহতে আকাশ ও স্থল থেকে হামলা চালানো শুরু করেছে আর বাসিন্দাদের শহরটির কিছু অংশ ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অন্যদিকে এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেন, যুদ্ধবিরতির যে পরিকল্পনা হামাস অনুমোদন করেছে, তা মিশরীয় প্রস্তাবের একটি দুর্বল সংস্করণ, আর এতে এমন উপাদান আছে যা ইসরায়েল মেনে নিতে পারবে না। তিনি বলেন, এটি ইসরায়েলকে চুক্তি প্রত্যাখ্যানকারী একটি পক্ষের মতো দেখানোর কৌশল হতে পারে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবগুলো ইসরায়েলের দাবি পুরোপুরি পূরণ করতে পারেনি; তার পরও চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টায় মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠক করতে একটি প্রতিনিধিদল পাঠাবে তারা। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনা ফের শুরু করতে মঙ্গলবার তাদের একটি প্রতিনিধিদল কায়রো যাবে।
রাফাহ ক্রসিংয়ের দখল নিল ইসরায়েল: গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত রাফাহ ক্রসিংয়ের দখল নিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। মঙ্গলবার আইডিএফের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গত রাতে আইডিএফের সেনারা রাফাহ ক্রসিংয়ের গাজা অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এ মুহূর্তে ক্রসিংয়ের যাবতীয় অপারেশনাল কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের সেনারা। ক্রসিংয়ের আশপাশে সন্ত্রাসীদের কোনো গোপন আস্তানা রয়েছে কি না, তার অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এই অনুসন্ধান শুধু ক্রসিংয়ের গাজা অংশে চলছে।’ গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত রাফাহ ক্রসিংয়ের একপাশে গাজা, অন্যপাশে মিশরের সিনাই উপদ্বীপ। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামাসের হামলা এবং তার জবাবে গাজায় আইডিএফের অভিযান শুরুর আগ পর্যন্ত এই সীমান্ত পথটিকে গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘লাইফ লাইন’ বলে বিবেচনা করা হতো। কারণ এই সীমান্ত পথ দিয়েই খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানিসহ জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর সরবরাহ প্রবেশ করত গাজায়। তবে ৭ অক্টোবর থেকে সেটি বন্ধ করে দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। মাঝেমধ্যে ত্রাণের গাড়ি প্রবেশের জন্য খুললেও গত ৭ মাসের অধিকাংশ সময় বন্ধই থেকেছে রাফাহ ক্রসিং।
এদিকে পুরা উপত্যকাজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যাপক বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচতে রাফাহ শহরে জড়ো হয়েছিলেন ১০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি। এখন সেখানে ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরু হলে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রোববার রাফাহর কাছাকাছি এলাকায় হামাসের হামলায় চার ইসরায়েলি সেনা নিহত হওয়ার পর রাফাহর পূর্বাঞ্চল থেকে সাধারণ মানুষকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। তার পর থেকে সেখান থেকে সরে যেতে শুরু করেছে হাজারো ফিলিস্তিনি।