টাঙ্গাইলের আনিছুর রহমান নিজের কিডনি বিক্রি করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন। দেখেছিলেন কিডনি প্রতিস্থাপনের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। এরপর নিজেই গড়ে তুলেছেন কিডনি বিক্রির ভয়ংকর চক্র। তার চক্র গত চার বছরে প্রতারণার মাধ্যমে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির কিডনি বিক্রি করেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে আনিছ ও তার চক্রের আরও চার সদস্যকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়ে এসব কথা জানান সংস্থাটির কর্মকর্তারা। আনিছ ছাড়া গ্রেপ্তার অন্য সদস্যরা হলো মো. আরিফুল ইসলাম রাজীব, সালাউদ্দিন তুহিন, সাইফুল ইসলাম ও এনামুল হোসেন। গত বুধবার তাদের রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা এবং ভুক্তভোগীর সঙ্গে করা চুক্তির এফিডেভিট কপি উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, বিত্তবান গ্রহীতার কাছ থেকে কিডনিপ্রতি ৫০ লাখ টাকা নিত চক্রের সদস্যরা। তবে প্রতারণার শিকার ‘কিডনিদাতা’ ভুক্তভোগীকে দেওয়া হতো মাত্র চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। বাকি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়া হতো।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মোস্তাক আহমেদ জানান, চিকিৎসার জন্য ভুয়া কাগজপত্রে ভারতে গিয়ে প্রতারিত হন আনিছ। অর্থের বিনিময়ে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন। তবে সেখানে কিডনি প্রতিস্থাপনের রোগীদের ব্যাপক চাহিদা দেখে প্রলুব্ধ হয়ে দেশে ফিরে নিজেই কিডনি বেচাকেনার অবৈধ ব্যবসায় নামেন। সেখানে ভারতে অবস্থানরত কিডনি ক্রয়-বিক্রয় চক্রের সহযোগিতায় একটি দালাল চক্র গড়ে তোলেন। অনলাইনে বিত্তশালী কিডনি রোগী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনি ডোনার সংগ্রহ করে বৈধ ও অবৈধভাবে বিমানে বা স্থলপথে ভারতে পাঠাত এই চক্রটি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে অসহায় মানুষগুলোকে টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদ পাতে এই চক্র। কখনো তারা বলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে একটির বেশি কিডনি দরকার নেই। কখনো মিথ্যা আশ্বাস দেয়, চিকিৎসার খরচ তারা বহন করবে। টাকার লোভে কিডনি হারিয়ে প্রায়ই অকর্মণ্য হয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে অসহায় মানুষগুলো।
সম্প্রতি সরকারি একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে দেশের প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনে প্রতারণার বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে। এই প্রতারণার সঙ্গে এ চক্রটি জড়িত কি না—প্রশ্নে র্যাব-১-এর অধিনায়ক বলেন, গ্রেপ্তার চক্রটির সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার এমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি।
চার স্তরে ফাঁদ কিডনি প্রতারকদের : র্যাব কর্মকর্তারা জানান, চক্রের প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে। দ্বিতীয় স্তরে আনিছ ঢাকায় বসে বিদেশে ডোনার পাঠানোর বিষয় তদারকি করে। তৃতীয় স্তরে রয়েছে গ্রেপ্তার আরিফ ও তুহিন। এরা আনিছের হয়ে প্রথম স্তরে থাকা সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে। পরে এরা তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে। এরপর আনিছ ঢাকার বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনপ্রত্যাশী রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে চতুর্থ স্তরে থাকা ‘সাহেবানা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল্সের’ মালিক সাইফুল ইসলাম দায়িত্ব নেন। সে প্রলোভনের শিকার ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারদের পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এবং ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ডোনারকে প্রতিবেশী দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করেন। পরে কিডনি ডোনারকে আনিছ প্রতিবেশী দেশে নিয়ে যান। কিডনি রেখে দেওয়ার পর ভিকটিমদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
৫০ লাখে কে কত পান : গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব কর্মকর্তারা জানান, বিদেশে অবস্থানরত একেকজন কিডনি ক্রেতা জীবন বাঁচাতে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে কিডনি কেনেন; কিন্তু এটা দেশে থাকা আনিছের চক্রের সদস্যরা জানে না। কিডনি বিক্রির এই টাকার মধ্যে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা দরিদ্র ডোনারকে দেওয়া হয়। ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার ভাগবাটোয়ারা হয় দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় দালাল, অসাধু ট্র্যাভেল এজেন্ট এবং অন্যান্য প্রতারকদের মধ্যে। বাকি প্রায় ৩০ লাখ টাকা ভোগ করে বিদেশে অবস্থানরত কিডনি পাচারের আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট।
মন্তব্য করুন