

শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান, ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হিসেবে প্যারিসের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে ল্যুভর জাদুঘর। এ জীবন্ত গ্রন্থাগারে মিশে আছে হাজার বছরের ইতিহাস—মিশরের ফেরাউন থেকে ফরাসি রাজপরিবার, রেনেসাঁর শিল্পী থেকে আধুনিক সময়ের প্রতিচ্ছবি। এখানে সংরক্ষিত মোনালিসার রহস্যময় হাসি থেকে শুরু করে ফরাসি রাজাদের মুকুট—প্রতিটি নিদর্শন বলে যায় সময়ের অমর কাহিনি। প্রতি বছর কোটি দর্শক আসেন ইতিহাসের এ তীর্থস্থানে, যেখানে প্রতিটি দেয়াল, ভাস্কর্য ও গ্যালারি এক একটি যুগের সাক্ষী। কিন্তু এ জৌলুস ও কড়া নিরাপত্তার ভেতরেও ঘনীভূত হয়ে আছে এক রহস্য—বারবার চুরি হওয়া অমূল্য নিদর্শন যেন প্রশ্ন তোলে, মানবসভ্যতার এ রত্নভান্ডার সত্যিই কতটা নিরাপদ? বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ জাদুঘর কেন বারবার দুঃসাহসী চোরদের লক্ষ্যবস্তু— এর কারণগুলো নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন হুমায়ূন কবির
ল্যুভর জাদুঘর সাম্প্রতিক আলোচনায় আসার কারণ গত রোববারের চুরি। মাত্র চার মিনিটে সেখানে একটি চুরির ঘটনা শোরগোল ফেলে দিয়েছে বিশ্বজুড়ে। জাদুঘরটি থেকে চোখের পলকে চুরি হয়ে যায় নেপোলিয়ন যুগের অলংকার। এর মধ্যে রয়েছে ফরাসি রাজপরিবারের বহু পুরোনো অলংকার—এমেরাল্ড নেকলেস ও কানের দুল, যা নেপোলিয়ন তার দ্বিতীয় স্ত্রী মারি লুইজকে বিবাহের সময় উপহার দিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠছে, উন্নত প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও কেন ল্যুভরে বারবার চুরি হয়?
অমূল্য ও সহজে বিক্রিযোগ্য সংগ্রহ : ল্যুভরের সংগ্রহশালায় রয়েছে এমন সব বস্তু, যেগুলো শুধু ঐতিহাসিক দিক থেকে নয়, অর্থনৈতিক মূল্যেও অপরিমেয়। এখানে রাখা আছে ফরাসি রাজপরিবারের গহনা, সম্রাজ্ঞী ইউজেনির ডায়াডেম, সম্রাজ্ঞী মেরি-লুইসের এমেরল্ড নেকলেস, মুকুট প্রভৃতি। এসব বস্তু একদিকে ছোট ও বহনযোগ্য, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর কালোবাজারি মূল্য বিপুল। চোরদের জন্য এটি এক ‘পারফেক্ট টার্গেট’—এক হাতে বহনযোগ্য, অথচ লাখো ডলারের সম্পদ। ভবনের গঠনগত দুর্বলতা : ল্যুভর মূলত ১২শ শতকের একটি দুর্গ থেকে ধাপে ধাপে মিউজিয়াম হয়েছে। এর স্থাপত্য জটিল, বড় এবং বিভিন্ন সময়ের নির্মাণে তৈরি—যার মধ্যে রয়েছে শতাধিক প্রবেশ ও প্রস্থান পথ, শতাধিক গ্যালারি ও ভূগর্ভস্থ সংযোগ। এত বিশাল স্থাপনা আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পুরোপুরি কাভার করা কঠিন। অনেক জানালা, গম্বুজ এবং পুরোনো অংশে এখনো আধুনিক সেন্সর বা রিইনফোর্সড গ্লাস বসানো হয়নি। ফলে চোরেরা প্রায়ই এসব দুর্বল পয়েন্ট ব্যবহার করে প্রবেশ করে—যেমন সাম্প্রতিক ঘটনায় চোরেরা ট্রাক-লিফট ব্যবহার করে জানালা ভেঙে ঢুকেছিল।
নিরাপত্তা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা: ল্যুভরের নিরাপত্তা বিশ্বমানের হলেও তা নিখুঁত নয়। সেখানে প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার দর্শক প্রবেশ করেন। এত বিশাল ভিড়ের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুরোপুরি নজরে রাখা অসম্ভব। কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, নিরাপত্তা কর্মীর সংখ্যা তুলনামূলক কম এবং শিফটের সময় পর্যাপ্ত বিশ্রাম বা নজরদারির ব্যবস্থা নেই। গত রোববারের চুরির পর জানা গেছে, মিউজিয়ামের অ্যালার্ম সিস্টেম কয়েক মিনিট বিলম্বে সক্রিয় হয়েছিল, যা ‘দ্রুত চুরির’ জন্য যথেষ্ট সময় তৈরি করেছিল।
অভ্যন্তরীণ তথ্যফাঁস: পূর্বের কিছু তদন্তে প্রমাণ মিলেছে—সাবেক নিরাপত্তাকর্মী বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছিল। এমনকি, রোববারের ঘটনাতেও পুলিশের ধারণা, চোর দল আগে থেকেই প্রদর্শনী কেসের ডিজাইন ও গ্যালারির সময়সূচি জানত। এটি সম্ভবত ‘ইনসাইড ইনফরমেশন’ ছাড়া সম্ভব নয়।
প্রযুক্তিগত ঘাটতি ও পুরোনো সিস্টেম: যদিও ল্যুভর আধুনিক সিসিটিভি ও অ্যালার্ম ব্যবহার করে, তবুও অনেক সিস্টেম পুরোনো। কিছু ক্যামেরা অ্যানালগ, কিছু অংশে ব্লাইন্ড-স্পট রয়েছে, আবার অনেক অ্যালার্ম সেন্সর কয়েক সেকেন্ড দেরিতে সক্রিয় হয়। চোরেরা এ প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা কাজে লাগায়। দ্রুত প্রবেশ-পালানোর কৌশলে (যেমন মাত্র ৫ মিনিটে অপারেশন সম্পন্ন) তারা জানে অ্যালার্ম বাজলেও পুলিশের প্রতিক্রিয়া আসতে সময় লাগে। আইনগত ঝুঁকি কম, মুনাফা বেশি: চুরি করা শিল্পকর্ম বা গহনা সাধারণ বাজারে বিক্রি করা কঠিন হলেও, আন্তর্জাতিক কালোবাজারে এর চাহিদা বিপুল। কালেক্টর, মধ্যস্থ দালাল ও প্রাইভেট নিলামকারীরা এসবের ক্রেতা চোরদের কাছে এটি ‘কম ঝুঁকি-উচ্চ মুনাফা’ ব্যবসা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূল বস্তু উদ্ধার হয় না। প্রশাসনিক ধীরগতি ও আমলাতান্ত্রিক জট: বড় সরকারি প্রতিষ্ঠানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক সময় ধীর হয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিবর্তন বা নতুন প্রযুক্তি সংযোজনের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন, বাজেট অনুমোদন এবং সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র লাগে। রোববারের চুরির আগে কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী লিখিতভাবে জানিয়ে ছিলেন যে, ‘গ্যালারি দ্য আপোলন’র জানালার অ্যালার্ম কাজ করছে না। কিন্তু প্রশাসনিক অনুমোদনের অপেক্ষায় সেটি ঠিক হয়নি। এ ধরনের ধীরগতি অপরাধীদের জন্য ‘সময় উপহার’ হিসেবে কাজ করে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিপুল মূল্য ও মানসিক আকর্ষণ: ল্যুভরে চুরি শুধু আর্থিক নয়, মানসিক উত্তেজনাও তৈরি করে। বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত জাদুঘরে চুরি করা যেন এক ধরনের ‘অবৈধ গৌরব’। অনেক অপরাধী চক্র এ প্রতীকী লক্ষ্যবস্তু বেছে নেয়—কারণ ল্যুভর থেকে কিছু চুরি মানেই বিশ্বমিডিয়ার দৃষ্টি পাওয়া।
বৈশ্বিক অপরাধচক্রের জড়িত থাকা: ল্যুভরের মতো জায়গায় চুরি সাধারণত একক ব্যক্তির কাজ নয়। এর সঙ্গে জড়িত থাকে আন্তর্জাতিক অপরাধচক্র, যারা পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও পাচার নেটওয়ার্ক তৈরি করে। রত্ন, পেইন্টিং বা ভাস্কর্য বিদেশে পাচার করতে তাদের সুসংগঠিত রুট থাকে—দক্ষিণ ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে।
নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের সংকট: যদিও ল্যুভর ফরাসি সরকারের অর্থায়নে চলে, তবুও নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের বাজেট পর্যাপ্ত নয়। প্রশাসনকে একই সঙ্গে শিল্পসংরক্ষণ, প্রদর্শনী, গবেষণা ও পর্যটন-ব্যবস্থাপনা সামলাতে হয়। নিরাপত্তা প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার, তা প্রায়ই কমে আসে।
বিশ্বজুড়ে আর্ট-ক্রাইমের উত্থান: সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ‘আর্ট-ক্রাইম’ একটি সংগঠিত বৈশ্বিক ব্যবসায় রূপ নিয়েছে। ইন্টারপোলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৫০ হাজার শিল্পকর্ম চুরি বা পাচার হয়। ল্যুভরের মতো জায়গা এ চক্রের প্রথম লক্ষ্য—কারণ এখানে যে কোনো বস্তু চুরি করলে তা বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে। এ অপরাধ-বাজারের উপস্থিতি এবং ক্রেতার সহজলভ্যতা ল্যুভরে চুরির পুনরাবৃত্তিকে আরও উৎসাহিত করে।
মন্তব্য করুন