পবিত্র কোরআন মুমিন জীবনের অন্যতম সঙ্গী। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সারা বছরই কোরআন খতম করেন। তবে রমজান মাসে কোরআনের গুরুত্ব বেড়ে যায় বহুগুণে। কারণ এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে পবিত্র এ গ্রন্থ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস—যে মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে...।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)। প্রতি রমজানে রাসুলুল্লাহ (সা.) জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে কোরআন ‘দাওর’ (একে অন্যকে শোনানো) করতেন। (বোখারি, হাদিস: ১৯০২)। কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা মেনে মুসলিম মনীষীরা বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে রমজান অতিবাহিত করতেন।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.): ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ইলমি মর্যাদা সম্পর্কে প্রায় কমবেশি সবাই অবগত। ইসলামী ফিকাহ সংকলনের ব্যস্ততা এবং শিক্ষা ও শিক্ষাদানে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি রমজানে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করতেন। রমজানের প্রত্যেক দিন ও রাতে তিনি একবার একবার করে কোরআন খতম করতেন আর এই একই আমল ঈদুল ফিতরের দিন ও রাতেও অব্যাহত থাকত। এভাবে তিনি সর্বমোট ৬২ বার কোরআন খতম করতেন। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) প্রত্যেক দিন ও রাতে কোরআন খতম করতেন এবং যখন রমজান মাস আসত, তখন তিনি ঈদুল ফিতরের দিন ও রাতসহ সর্বমোট ৬২ বার কোরআন খতম করতেন। (আখবারু আবি হানিফা ওয়া আসহাবিহি, পৃষ্ঠা ৫৫)
ইমাম শাফেয়ি (রহ.): ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ছিলেন একজন উচ্চমর্যাদার ফকিহ ও মুহাদ্দিস। তিনি সর্বদা ইলম প্রচার-প্রসারে নিয়োজিত থাকতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি অধিক কোরআন তেলাওয়াত করতেন। তবে রমজান মাস এলেই তা দ্বিগুণ হারে বেড়ে যেত যে, দিনে এক খতম ও রাতে এক খতম করতেন। এভাবে তিনি রমজান মাসে ৬০ বার কোরআন খতম করতেন। রাবি বিন সুলাইমান (রহ.) বলেন, ইমাম শাফেয়ি (রহ.) প্রতি রাতে এক খতম করতেন এবং যখন রমজান আসত, তখন রাতে এক খতম এবং দিনে আরেক খতম করতেন। ফলে তিনি রমজান মাসে মোট ৬০ বার কোরআন খতম করতেন। (তারিখে দামেস্ক লি ইবনে আসাকির, খণ্ড ৫১, পৃষ্ঠা ৩৯২)
ইমাম বোখারি (রহ.): ইমাম বোখারি (রহ.)-এর মতো মহা মনীষীর কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন নেই। পৃথিবীতে এমন একটি লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে তার নাম শোনেনি। হাদিস প্রচার ও প্রসারে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি রমজানে বহুবার কোরআন খতম করতেন। সেহরির সময়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কোরআন তেলাওয়াত করা এবং প্রতি তিন দিনে একবার সেহরির সময়ে কোরআন খতম করা ছিল তার অভ্যাস। একইভাবে তিনি প্রতিদিন দিনের বেলায় ইফতারের সময় কোরআন খতম করতেন। কেননা একদিকে ইফতারের সময় হলো দোয়া কবুল হওয়ার সময় আর দ্বিতীয়ত কোরআন খতম উপলক্ষেও দোয়া কবুল হয়। খতিবে বাগদাদি (রহ.) বলেন, ইমাম বোখারি (রহ.) সেহরিতে কোরআনের অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ তেলাওয়াত করতেন এবং প্রতি তিন রাতে সেহরিতে কোরআন খতম করতেন এবং প্রতিদিন দিনের বেলায়ও কোরআন খতম করতেন। আর এই খতম ছিল ইফতারের সময় এবং তিনি বলতেন যে, প্রত্যেক খতম শেষে দোয়া কবুল হয়। (তারিখে বাগদাদ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৩১)
মুহাম্মদ বিন মুহাম্মাদ তুনসি (রহ.): হাম্মদ বিন মুহাম্মাদ বিন আবদুর রহমান তুনসি (রহ.) তার সময়ের একজন বিখ্যাত বুজুর্গ এবং ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। প্রথম দিকে তিনি একজন বণিক ও প্রচুর সম্পদের অধিকারী ছিলেন, কিন্তু তিনি তার সব সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করেন আর সারাক্ষণ ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। কোরআনের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ছিল; তাই তিনি রমজানে ১০০ বার কোরআন খতম করতেন। আল্লামা ইবনুল খতিব (রহ.) বলেন, তিনি রমজান মাসে ১০০ বার কোরআন খতম করতেন। (আল ইহাতাতু ফি আখবারি গারনাতাহ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২০৫)
মাহমুদ বিন আবি বকর জাজারি (রহ.): মাহমুদ বিন আবি বকর জাজারি (রহ.) ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর মতাদর্শের ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন উলুম ও ফুনুনে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও পরে সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ইবাদত ইত্যাদিতে অনেক সময় ব্যয় করতেন। তিনি কোরআন তেলাওয়াত করতে খুব পছন্দ করতেন এবং রমজান মাসে আরও বেশি উৎসাহের সঙ্গে তেলাওয়াত করতেন। সেজন্য তিনি রমজান মাসে প্রতিদিন দুবার কোরআন খতম করতেন। ইতিহাসবিদরা বলেন, তার বহু গুণ রয়েছে; তন্মধ্যে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, তিনি একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন রোজা ভঙ্গ করতেন। আর রমজান মাসে তিনি একটি নির্জন স্থানে একাকিত্ব অবলম্বন করতেন, যেখানে তিনি দিনে একবার এবং রাতে একবার কোরআন খতম করতেন। (সিলকুদ দুরার, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১২৭)
মুহাম্মদ জাহিদ বিন উমর (রহ.): শায়খ মুহাম্মাদ জাহিদ বিন উমর (রহ.) ছিলেন হারামাইন শরিফের অন্যতম আলেম। মসজিদে নববিতে শিক্ষকতার সৌভাগ্যও হয়েছে তার। ইলমি ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি রমজানে বেশি পরিমাণে তেলাওয়াত করতেন এবং প্রতি রাতে নামাজে কোরআন খতম করতেন। তার কোরআন শরিফের দৃঢ় হিফজ সম্পর্কে জানার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তৎকালীন একদল আলেম তার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিলেন—এক রাতে কোরআন খতম করার কারণে শব্দের সঠিক উচ্চারণ হয় না। সেজন্য তারা তাদের একজন লোককে শায়খ মুহাম্মাদ জাহিদ (রহ.)-এর পেছনে দাঁড় করিয়ে দেন, যাতে শায়খের তাজবিদ, তারতিল, শব্দ বা অন্য কোনো উপায়ে ভুল পেলে সে যেন তাদের অবগত করে। আর তারা প্রতিটি ভুল চিহ্নিত করার জন্য তাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা হাদিয়া দেওয়ার ঘোষণা দেন। সেজন্য ওই ব্যক্তি শায়খ মুহাম্মদ জাহিদ (রহ.)-এর পেছনে দাঁড়িয়েছিল। শায়খ রাতে পুরো কোরআন খতম করেছিলেন, কিন্তু সেই ব্যক্তি তার একটি ভুলও খুঁজে পায়নি। (আলাম মিন আরদ আন-নবুওয়্যাহ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১০৪)। এমনই ছিল মুসলিম মনীষীদের কোরআনময় রমজান। তাই আমাদের উচিত বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা এবং কোরআনময় জীবন গড়া। মহান আল্লাহ তওফিক দান করুন।
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক
মন্তব্য করুন