ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ছোট গাজা শহরে ক্ষুধা ও মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত গাজা শহরের মানুষ দেখে শুধু ক্ষুধা ও মৃত্যু। দেখে বোমার লেলিহান শিখা ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী, মানুষের প্রবাহিত রক্ত ও ক্ষুধার যন্ত্রণায় শুকিয়ে যাওয়া শরীরের খুলি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, গাজা এই মুহূর্তে আধুনিক যুগের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। কারণ অবরোধ এখনো চলমান, পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও খাদ্যসহায়তা ঢুকতে পারছে না এবং উদ্বাস্তুদের অবস্থানেও বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে।গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকার ওপর নতুন করে আগ্রাসন শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছে এবং সাড়ে নয় হাজার আহত হয়েছে। ২০ মার্চ মন্ত্রণালয় আরও জানায়, এ সময়ের মধ্যে ইসরায়েলি বিমান হামলা লক্ষ্যবস্তু করেছে স্কুলগুলোকে, যেখানে উদ্বাস্তুরা আশ্রয় নিয়েছিল; জাতিসংঘের ‘ইউএনআরডব্লিউএ’ সংস্থার শরণার্থী কেন্দ্র ও জনবহুল আবাসিক এলাকাগুলোকেও। এসব হামলায় ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, বিশেষ করে গাজা শহর ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া আগ্রাসনের পর থেকে এখন পর্যন্ত শহীদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার এবং আহতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার জন।
মন্ত্রণালয় আরও জানায়, বর্তমানে ১০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে নিখোঁজ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের অনেকেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে শহীদ হয়েছে আর বাকিদের খবর পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না; কারণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং বহু বিপর্যস্ত এলাকায় পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন। সীমিত সম্পদের মধ্যেই কাজ করে চলেছে সিভিল ডিফেন্স ও অ্যাম্বুলেন্স টিমগুলো—চরম ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, পুরো গাজা উপত্যকার অধিকাংশ এলাকায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে এবং ৮০ শতাংশেরও বেশি হাসপাতাল সেবার বাইরে চলে গেছে।
৬৪ দিন ধরে চলা লাগাতার বোমাবর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞে সাধারণ মানুষের ওপর চালানো অপরাধের ভয়াবহতা তুলে ধরে গাজার সাংবাদিক ও কবি নুর আল-আসির লিখেছেন—দুঃখ, অনাহার ও জবরদস্তি নির্বাসনের ক্লান্তি তাকে বিদায়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, কিন্তু তার আগে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন গাজার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। নুর আরও লিখেছেন, আজ গাজা শুধু বোমা ও গুলির দ্বারা নয়, ক্ষুধার দ্বারাও অবরুদ্ধ। ইসরায়েল যখন থেকে গাজার ভেতরে মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দেয়, তখন থেকেই তার ক্ষীণ জীবনের আশাটুকুও একে একে নিঃশেষ হতে থাকে। এখানে মানুষ আবর্জনার স্তূপের মধ্যে ঘুমায়; নেই পরিষ্কার পানি, নেই কার্যকর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বা ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধিও। ফলে রোগ ছড়াচ্ছে, ক্ষুধায় জর্জরিত শিশুরা মারা যাচ্ছে ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস-এ এবং চর্মরোগে।
নুর আল-আসির বলেন, সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির পতনের পর থেকে তিনি আরও কঠোর পরিশ্রম করছেন, চূড়ান্ত প্রতীকূল পরিস্থিতিতেও তিনি প্রতিবেদন তৈরি করতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। প্রায়ই তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে কিংবা ঠান্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, সেসব পরিবারের সাক্ষাৎকার নিতে, যাদের পৃথিবী সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে।
নুর জানিয়েছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ টিনজাত খাবার খাওয়ার ফলে তার হজমপ্রণালিতে সমস্যা হয়েছে। চিকিৎসক তার পায়ের তীব্র ব্যথার কারণ হিসেবে ‘সিডিমেন্টেশন রেট বেড়ে যাওয়া’কে দায়ী করেছেন, যা দাঁড়িয়ে থাকা, অপুষ্টি ও চিকিৎসাহীনতার ফলে বেড়েছে। কারণ এখানে ওষুধ ও ভিটামিনেরও অভাব; অর্থাৎ আরোগ্য হওয়া কার্যত অসম্ভব।
প্রতিদিনই ইসরায়েল গাজা ত্যাগে বাধ্য করছে। তারা চায় গাজার মানুষ নিজের ভিটেমাটি, স্বপ্ন, শিকড় ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের অতীত আশ্রয় ভুলে যাক। এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছি যে, অনেকে ফিলিস্তিনের কথা ভাবলেই মনে পড়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা, দুর্ভিক্ষ, জানাজার মিছিল আর অপমান। গাজার মানুষের অভিজ্ঞতা শুধু মানবিক বিপর্যয় নয়, বরং এটি একবিংশ শতাব্দীর মানুষের তৈরি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং প্রকাশ্যে দিনের আলোয় সংঘটিত নিষ্ঠুর গণহত্যা।
* আলজাজিরা আরবি অবলম্বনে
মন্তব্য করুন