প্রত্যেকটা অভ্যুত্থান একেকটা অবিস্মরণীয় দৃশ্যকল্পের জন্ম দেয়। আমাদের জুলাই অভ্যুত্থান থেকেও আমরা পেয়েছি কিছু অজর অমর দৃশ্য, যা এই জাতির মানসপটে অক্ষয় হয়ে রইবে। জুলাই অভ্যুত্থান থেকে আমরা যত আইকনিক দৃশ্য পেয়েছি, তার মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য আবু সাঈদের পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়ানোর দৃশ্যটি। আছে রোদে-ঘামে নেয়ে ওঠা, টিয়ার গ্যাসের ছোবলে ভালো করে তাকাতে না পারা মুগ্ধ আর তার ‘পানি লাগবে, ভাই, কারও পানি লাগবে’—এই বুকভাঙা দৃশ্যটি! বলে হয়তো শেষ করা যাবে না এমনি আরও অনেক দৃশ্যকল্প, যা চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।
এরই মধ্যে একটা দৃশ্য ছিল নুসরাতের পুলিশের ট্রাকের সামনে একলা দাঁড়িয়ে সেটাকে আটকে দেওয়ার দৃশ্যটি। আজ থেকে বহু বছর আগে (১৯৮৯ সালে) ঘটে যাওয়া চীনের তিয়েনানমেন স্কোয়ারের সেই উত্তাল ছাত্র বিক্ষোভের কথা হয়তো অনেকেই জানেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির দমনপীড়নের বিরুদ্ধে ঠিক আমাদের জুলাই অভ্যুত্থানের মতোই ফুঁসে উঠেছিল ছাত্র-জনতা। ঠিক আমাদের স্বৈরাচারী শাসকের মতো করেই ওরাও জোর করে এ আন্দোলন দমাতে চেয়েছিল, পথে নেমে এসেছিল সেনাবাহিনী, সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাঙ্ক। ছাত্রদের গুলি করে, পিষে থামাতে চেয়েছিল চীনের ক্ষমতাসীনরা—যেমনটা স্বৈরশাসকরা সবসময় চায়। রাষ্ট্রের এ ভয়ানক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন বাজারফেরতা এক সাধারণ মানুষ। তার দুই হাতে বাজারের ব্যাগ। তিনি ওই দুই ব্যাগ আর অসম সাহস সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন চীনের ট্যাঙ্ক বাহিনীর সামনে! এবং কিমাশ্চর্যম! যারা ভেবেছিল এই বুঝি ট্যাঙ্ক এই দুবলা-পাতলা লোকটিকে পিষে দিয়ে এগিয়ে যাবে—দেখা গেল, ঘটনা ঘটল তার উল্টো। পরাক্রমশালী ট্যাঙ্কগুলো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আগ্নেয়াস্ত্রে সুসজ্জিত এই মারণ-শকট স্রেফ একবুক সাহস আর ঘৃণা নিয়ে দাঁড়ানো লোকটার সামনে হতবুদ্ধি হয়ে থেমে গিয়েছিল। সেই থেকে এই নাম না জানা মানুষটি সারা বিশ্বে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আইকন হয়ে আছেন। সেই ১৯৮৯। আর আজ ২০২৪ সালে আমরা আমাদের নিজেদের ‘ট্যাঙ্ক-ম্যান’ খুঁজে পেলাম। ট্যাঙ্কম্যানরা হারিয়ে যায় না, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তারা ফিরে ফিরে আসে আমাদের বুকে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে দিতে।
তারেক আজিজ
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক