বাংলাদেশের ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলের সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার প্রধান কারণ অতিবৃষ্টি। আমাদের দেশে সাধারণত বেশি বৃষ্টিপাত হয় বর্ষা এবং শরৎ ঋতুতে। কারণ এ সময় বিপুল জলীয় বাষ্প নিয়ে মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হয়। দেশের সাম্প্রতিক বন্যাও ঘটেছে এই বিপুল জলীয় বাষ্প ভরা মৌসুমি বায়ুর কারণেই। জলীয় বাষ্প ভরা বাতাস ভারতের ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চলে বাধা পেয়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে। গত দুই মাস বর্ষা ঋতু হওয়ায় এমনিতেই কম বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। খাল-বিল ভরে গেছে এবং নদীতে পানির স্তর বেড়েছে। যে কারণে এখন যখন অতিভারি বৃষ্টি হলো তখন খাল-বিলে পানি টেনে নিতে পারেনি। ফলস্বরূপ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ল বিস্তীর্ণ জনপদ।
ভারত বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়ায় ফেনী বা কুমিল্লায় বন্যা হয়েছে—এ কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। ত্রিপুরায় ভারতের ডম্বুর বাঁধ যদি হঠাৎ খুলে দেওয়া হয়, তাহলে আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ত্রিপুরার নিম্নাঞ্চল। ত্রিপুরার একজন মন্ত্রীও জানিয়েছেন, এত বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে যে বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে আগে ত্রিপুরা বন্যাকবলিত হয়েছে এবং ঢালুপথে সেই পানি বাংলাদেশেও প্রবেশ করেছে। একই সঙ্গে ভারতের উঁচু ভূমি থেকে নেমে আসা পানি এবং বাংলাদেশের ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলে হওয়া ব্যাপক বৃষ্টি—দুইয়ে মিলে এ অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতীয় গণমাধ্যম যেভাবে বিষোদ্গার করেছে, তা কোনোভাবে ঠিক হয়নি। এটি একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। ভারতের এই আচরণের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের যুব সমাজও ভারতবিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি কিছু গণমাধ্যম ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করেছে যে, ভারত বাঁধ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ পানিতে ডুবেছে। আর এসব সংবাদ নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বিষয়টি একদমই সেরকম ছিল না। বন্যায় ভারত নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, একই সঙ্গে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যেহেতু ভারতের ত্রিপুরা আমাদের থেকে কিছুটা উঁচু অঞ্চল। ফলে ত্রিপুরা বন্যাকবলিত হওয়ার পর সেই পানি নিচের দিকে অর্থাৎ বাংলাদেশের দিকে চলে এসেছে।
আরেকটা দিকে আমাদের খেয়াল করতে হবে, বাংলাদেশের নদীনালাগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হয়েছে। যদি নদী ও খালগুলো সবসময় প্রয়োজনমতো খনন করা হতো এবং পানি প্রবাহের পথ থাকত তাহলে বন্যা পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হতো না। পানি দ্রুত নেমে যেতে পারত। আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ভাবতে হবে, কীভাবে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়া যায়। পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখায় মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের ফেনীর নিম্নাঞ্চলে নদীর মুখে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচার জন্য একটি বাঁধ রয়েছে। যে কারণে নদীর ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার এলাকা গভীরতা হারিয়েছে। ফলে এই নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে। ভবিষ্যতে নিরাপত্তার জন্য এখানেও নদীর নাব্য বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
আগে আমরা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার প্রকোপ দেখতাম। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দক্ষিণের ফেনী চট্টগ্রাম অঞ্চলেও বড় ধরনের বন্যা দেখা যাচ্ছে। ২০২২ সালেও এখানে বড় আকারের বন্যা হয়েছে। ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম থানা এলাকা বেশ নিচু ভূমি। এর পূর্ব ও পশ্চিম দুদিকেই পাহাড়। ফলে ভারি বৃষ্টি হলে পুরো অঞ্চলের পানি এই দুটি উপজেলার মধ্য দিয়েই বের হয়ে যায়। ছোটখাটো বন্যা হলে সেটা আমরা ঠেকাতে পারি। কিন্তু বড় ধরনের বন্যা হলে সেখানে কিছু করার থাকে না। ফেনীর মুহুরী নদীসহ আরও যে দু-একটি নদী রয়েছে সেখানে আমাদের বাঁধ রয়েছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। এই বাঁধ ভারি বন্যা ঠেকাতে পারে না। যেহেতু পুরো ত্রিপুরা অঞ্চলজুড়ে বৃষ্টি হয়েছে এবং সমগ্র অঞ্চল বন্যায় ডুবে গেছে, তাই সব পানি নদী দিয়ে আসেনি। নদী ছাড়াও ঢালুপথে মাঠ-ঘাট দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। তাই শুধু বাঁধ দিয়ে বন্যা ঠেকানো যাবে তেমনটা নয়।
এ অঞ্চলের বন্যা মূলত ফ্ল্যাশ ফ্লাড। অর্থাৎ পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা পানির কারণে সৃষ্ট বন্যা। এ ধরনের বন্যা আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না। যদি এবারের বন্যাটা ভিন্নরকম। এ ধরনের বড় বন্যা শুধু পাহাড়ের ওপরে হওয়া বৃষ্টির কারণে ঘটে না; বরং পুরো অঞ্চলজুড়ে যখন ভারি বৃষ্টি হয় তখন বড় বন্যা সৃষ্টি করে। বড় বন্যার আগাম সতর্কতা পাওয়া যায়। আবহাওয়াবিদরা স্যাটেলাইট ইমেজ এবং অঞ্চলের বাতাসের আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণ করে বন্যার আগাম সতর্কতা জানিয়ে দিতে পারেন।
আমাদের এখন বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন কাজে মনোযোগ দিতে হবে। অনেকে সম্পদ হারিয়েছে, অনেকে বাড়িঘর হারিয়েছে, ফসলহানি ঘটেছে, আরও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষ। যদিও আমাদের বাংলাদেশের দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো। তার পরও আমরা দেখেছি, সারা দেশ থেকে মানুষ বন্যার্তদের সাহায্যার্থে কীভাবে এগিয়ে এসেছে। জাতি হিসেবে আমাদের ঐক্য দেখতে পেয়েছি আমরা। এটা আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক। এখন আমাদের পুনর্বাসন কাজে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা আশা করি সরকার অতি দ্রুত তার পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করবে এবং ক্ষতিগ্রস্তরা আবার নতুন করে তাদের জীবন শুরু করতে পারবে।
ম ইনামুল হক: প্রকৌশলী, সাবেক মহাপরিচালক, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট