হানি হাজাইমেহ
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৮ এএম
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৪ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নাসরুল্লাহর মৃত্যু আরবের জেগে ওঠার ডাক

নাসরুল্লাহর মৃত্যু আরবের জেগে ওঠার ডাক

একের পর এক বিস্ময়কর ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর হত্যা আরববিশ্বের জন্য তারই প্রতিফলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে ভাবা জরুরি। কেননা এ পরিস্থিতি শুধু হিজবুল্লাহ বা নাসরুল্লাহর সংগঠনের বা ব্যক্তিগত বিষয় নয়; বরং এ অবস্থা মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে একটি গভীর বোঝাপড়ার উদ্রেক করে। সেটি হচ্ছে—হিজবুল্লাহর মূল সমর্থক ইরান কি বিশ্বস্ত মিত্র? কারণ একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, দেশটির স্বার্থ বৃহত্তর আরব এবং মুসলিমবিশ্বের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

কয়েক দশক ধরে ইরান ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষা এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নিজেকে রক্ষাকর্তা ও অগ্রগামী হিসেবে ‘নিজস্ব ধরন’ সৃষ্টিতে অবস্থান তৈরি করেছে। তেহরান হিজবুল্লাহর মতো প্রক্সি গোষ্ঠীর মাধ্যমে লেবানন, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনে প্রভাব বিস্তার করেছে। এ বিষয়ে তাদের দাবি, তারা পশ্চিমা ও ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অগ্রভাগে রয়েছে। কিন্তু প্রতিরোধের মুখোশের আড়ালে তাদের রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার নমুনা বা ইঙ্গিত; যেখানে ইরানের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বেদিতে ক্রমাগত বলি হতে হচ্ছে আরব ও মুসলিম স্বার্থ।

ইরান এবং হিজবুল্লাহসহ তার মিত্ররা ‘ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার’ আকাঙ্ক্ষার উত্তপ্ত ঘোষণার বিষয়টি বহুশ্রুত। কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ বা মুখোমুখি অবস্থানে তাদের হুমকিগুলো অলংকারমূলক বা কথার কথা পর্যন্তই থেকে যায়; অর্থাৎ বাস্তবিক প্রতিফলন নেই বললেই চলে। ইরানের সামরিক এবং প্রক্সি বাহিনী বরাবরই মূলত প্রতিরক্ষামূলক। কেননা তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপের যেসব অঙ্গীকার রয়েছে, তা অনুসরণ করতে তারা অসফল হয়েছে। এদিকে হিজবুল্লাহ একটি মিলিশিয়া হিসেবে তার বরং শক্তি সংরক্ষণের নীতিতে চলতে দেখা যায়; যা সত্যিকার অর্থে ইসরায়েলের জন্য প্রকৃত অস্তিত্ব হুমকি তৈরি করতে পারেনি। সদ্য ইসরায়েল আগ্রাসনে হত্যার শিকার নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে সংগঠনটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ এবং বিচ্ছিন্ন রকেট হামলার ওপর নির্ভর করেছে। দেখা যায়, এসব হামলার সবকটিতেই ইসরায়েল দ্রুততার সঙ্গে ও সফলভাবে প্রতিহত করেছে।

নিষ্ক্রিয়তার এ ধরন প্রসারিত হয়েছে হিজবুল্লাহর বাইরেও। বৃহত্তর আরববিশ্বে একটি ক্রমবর্ধমান সচেতনতা বা ধারণা রয়েছে যে, ইরানের ‘প্রতিরোধের’ প্রতিশ্রুতি শুধুমাত্র আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা আরও গভীর করেছে। এর ফলস্বরূপ সংঘাত ও ধ্বংসের অন্তহীন চক্র লক্ষ করা যায়, বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে। নাসরুল্লাহর উত্তপ্ত বক্তব্যগুলো ইসরায়েলের ওপর চূড়ান্ত বিজয়ের একটি চিত্র এঁকেছিল বটে; কিন্তু বাস্তবে হিজবুল্লাহর পদক্ষেপগুলো ফিলিস্তিনি ইস্যুতে সামান্যই অগ্রগতি অর্জন করেছিল; সেটাও আবার লেবাননকে একটি চিরস্থায়ী সংঘাতময় অবস্থার দিকে আরও ঠেলে দিয়েছে এবং বিচ্ছিন্ন করেছে।

নাসরুল্লাহর এ হত্যাকাণ্ডকে তার মিত্রদের স্বার্থরক্ষা বা অগ্রগামী করার ক্ষেত্রে ইরানের ধারাবাহিক ব্যর্থতার সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে ইরাকের ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানগুলোর পতন পর্যন্ত ইরান বারবারই তার আঞ্চলিক অংশীদারদের দাবার বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করেছে। দেখা গেছে, শুধু তাদের কৌশলগত স্বার্থের দিকে তাকিয়েই অংশীজনদের মঙ্গল বিসর্জন দেওয়া হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ সিরিয়ার কথাই ধরুন। দেশটির বাশার আল আসাদের প্রতি ইরানের অটল সমর্থন আমাদের সময়ের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকটে ফেলতে ভূমিকা রেখেছে। দেশটিতে অর্ধমিলিয়নেরও বেশি মানুষ মারা গেছে এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাদের এ সমর্থন আসাদ রেজিমকে সুদৃঢ় করেছে; কিন্তু একইভাবে ইরানকে আরববিশ্ব থেকে করেছে বিচ্ছিন্ন। পাশাপাশি ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের প্রতি তেহরানের সমর্থন সৌদি আরবের সঙ্গে একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের দিকে পরিচালিত করেছে। এর ফলে সেখানে একটি মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে, যা চূড়ান্ত বিচারে আরব এবং মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীগুলোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

এ আঞ্চলিক দ্বন্দ্বগুলো শুধু ইসরায়েলকে পরাজিত করার অঙ্গীকারকেই ব্যর্থ করেনি; বরং ইরানের মিত্রদেরও বিচ্ছিন্ন করেছে। আর ইরানের তথাকথিত সুবিধাভোগীদের মধ্যে দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। লক্ষণীয় যে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইরানের সমর্থন আরব রাষ্ট্রগুলোর জন্য উচ্চমূল্য দিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েল বা পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাস্তবে কী অর্জন করতে পেরেছে বা কতটুকু সফল হয়েছে, তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

হাসান নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ড সমগ্র অঞ্চলের আরবদের জন্য এখন একটি হিসাব-নিকাশ বা পুনঃপর্যালোচনার দাবি রাখে। কেননা দীর্ঘদিন ধরে ইরানের ‘প্রতিরোধের’ বয়ানে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তেহরানের স্বার্থ ফিলিস্তিনের মুক্তি কিংবা আরব দেশগুলোর উন্নতি নয়; বরং দেশটির প্রভাব বিস্তার করাই তার লক্ষ্য। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের নিজস্ব কৌশলগত পদাঙ্ক সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় করা।

প্রাথমিকভাবে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে ইরানের সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরববিশ্বকে আরও খণ্ডিত করেছে। শুধু তাই নয়, তাদের বিভাজনের এ প্রবণতা বহিরাগত শক্তিগুলোর জন্য শোষণ করার ক্ষেত্রে সহজ করে তুলেছে। হিজবুল্লাহর মতো মিলিশিয়া এবং অরাষ্ট্রীয় শক্তিদের সমর্থন করে ইরান মূলত আরব সার্বভৌমত্বের ভিত্তিকেই দুর্বল করতে চেয়েছে। একই সঙ্গে সৃষ্টি করতে চেয়েছে বিশৃঙ্খলা এবং সবসময় দাবি করেছে ফিলিস্তিনিকে বিজয়ী করার।

এই মুহূর্তে আরব ও মুসলমানদের পুনরায় মূল্যায়ন করার সময় এসেছে যে, কারা তাদের প্রকৃত মিত্র এবং তাদের নিজেদের স্বার্থ আসলে কোথায় নিহিত। নাসরুল্লাহর মৃত্যু তাদের মধ্যে একটি অনুস্মারক হিসেবে কাজ করা উচিত। কারণ ইরান যখন একটি বড় খেলার কথা বলছে, তখন তার কর্মকাণ্ড প্রায়ই তার মিত্রদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। দুর্বল এবং আরও বিভক্ত করে দিচ্ছে বৃহত্তর আরববিশ্বকে। পাশাপাশি দূরে সরিয়ে দিচ্ছে এ অঞ্চলে সত্যিকারের শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনকে।

তেহরানের অবিরত ফাঁপা প্রতিশ্রুতিতে থাকার পরিবর্তে আরববিশ্বকেই তার নিজের ভাগ্যের দায়িত্ব নিতে হবে। আরবে কোনো সংকট ইস্যুতে ইরানের সম্পৃক্ততা না এনেছে মুক্তি, না এনেছে বিজয়। এর পরিবর্তে তারা এ অঞ্চলে এনেছে ধ্বংস, বিভাজন ও অস্থিরতা। নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ড হতে পারে চূড়ান্ত ইঙ্গিত, যা বিভ্রান্ত আরবদের সঠিক উপলব্ধি ঘটাতে সহযোগিতা করতে পারে। আর এ উপলব্ধি তাদের নতুন একটি জোট তৈরিতে অবদান রাখতে পারে; যার ভিত্তি হতে পারে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, স্বার্থ ভাগাভাগি; যা এগিয়ে দেবে শান্তির প্রকৃত সম্ভাবনার ভিত্তি গড়ে তুলতে।

আরববিশ্বকে তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য অবশ্যই নিজেদের এবং অন্যান্য মুসলিম জাতি ও দেশের মধ্যে ঐক্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শুধুমাত্র সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমেই এ অঞ্চলে ফিলিস্তিনি এবং সব আরবের জন্য শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচারের দিকে একটি পথনির্ধারণের প্রত্যাশা করা যেতে পারে। অন্যদিকে নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে বহিরাগত শক্তির ওপর নির্ভরতায় শুধু ব্যর্থতাই ফিরে আসবে।

এটা স্বীকার করার সময় এসেছে যে, ইরান আরববিশ্বের চ্যালেঞ্জের সমাধান নয়; বরং তারা সমস্যাগুলোর একটি অংশ।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সম্পাদক, আম্মান ডেইলি নিউজ। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন সঞ্জয় হালদার

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিজিবির কাছে ৫ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর করল বিএসএফ

চুরির অভিযোগ, গণপিটুনিতে যুবক নিহত

সংবিধানের মূলনীতি থেকে আমরা সরে যাচ্ছি : ড. কামাল হোসেন

রাকসু নির্বাচনে ভোটাধিকারের দাবিতে নবীন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

চট্টগ্রামের মিষ্টি কারখানায় স্বাস্থ্যঝুঁকি, মধুবন ফুডকে জরিমানা

আশুলিয়ায় সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

জাবির সাবেক সহকারী প্রক্টর জনি রিমান্ডে

প্রাণনাশের শঙ্কায় ভুগছেন ফজলুর রহমান, চাইলেন নিরাপত্তা

বাংলাদেশ সফর নিয়ে ইসহাক দারের প্রতিক্রিয়া

অপ্রতুল বিনিয়োগের কারণে চিকিৎসার মান কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছায়নি : ডা. রফিক 

১০

মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানানো থালাপতির উত্থানের গল্প

১১

চট্টগ্রামের নগরায়ণ সংকটে শহরবাসী, মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন নেই

১২

মুন্সীগঞ্জে পুলিশ ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলা, ব্যাপক গোলাগুলি

১৩

ইসরায়েলে সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা কতটুকু?

১৪

আন্দোলনের সময় ছাত্রদের নগ্ন ভিডিও করতেন তৌহিদ আফ্রিদি : আইনজীবী

১৫

৬ কোটি টাকার গার্ডার ব্রিজ এখন গলার কাঁটা

১৬

সরকারি চাকরি প্রার্থীদের জন্য সুখবর

১৭

পাকিস্তানকে বন্যা সতর্কতা পাঠিয়ে শুভেচ্ছার নিদর্শন দেখালো ভারত

১৮

শহর পরিষ্কারের দায়িত্ব সবার নিতে হবে : ডিসি জাহিদুল

১৯

ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে কাভার্ডভ্যান চালক নিহত

২০
X