হঠাৎই স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, মধ্য ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো। আকস্মিক এ বন্যায় ১২টি জেলাসহ তার আশপাশের অনেক জেলাই বন্যার প্রভাব ছিল। তাতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ। পানিবন্দি হয়েছে আরও প্রায় ১০ লাখ। এখন পর্যন্ত মারা গেছে ৬০-৭০ জন। এখনো দুর্বিষহ ক্ষুধা আর রোগ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আরও অসংখ্য মানুষ। বেশিরভাগ এলাকাতেই ধানের জমিসহ বাড়িঘর ডুবে গিয়েছিল। পুকুর পরিণত হয়েছিল অথৈ সায়রে। মাছ, হাঁস-মুরগি, গৃহপালিত পশু ভেসে গেছে সবই। তাদের খাদ্যের অভাব, সুপেয় পানির অভাব, ওষুধের অভাব, কাপড়ের অভাব বন্যাকবলিত এলাকায় তারা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। এরই মধ্যে অনেক মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এগিয়ে এসেছে অসহায় বানভাসি মানুষকে উদ্ধার করার জন্য, তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য। শুকনো খাবার, পানি, ওষুধ ও কাপড়সহ যে যা পারে; তা নিয়েই এসে দাঁড়িয়েছে আর্তমানবতার পাশে। এবার ছাত্রদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছিল অনেক সাধারণ মানুষ।
সাধারণত বন্যা হয় আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। এবার বন্যা হয়েছে বিলম্বে, ভাদ্র মাসে। অতিরিক্ত বর্ষণ ও দিন দিন খাল ভরাট হওয়াই বন্যার প্রধান কারণ। গত ১৮ থেকে ২২ আগস্ট বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে অবিরাম বৃষ্টি হয়েছে। বিরামহীন বৃষ্টি হয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও। এ দুটো অঞ্চলে বৃষ্টির রেকর্ড ছিল ১৫০ থেকে ৩০০ মিলিমিটারেরও অধিক। এই অতিবৃষ্টিই ছিল চলমান বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল সাগরের নিম্নচাপ। ত্রিপুরা বাংলাদেশের উজানে থাকায় পানি এসে নেমেছে আমাদের পূর্বাঞ্চলে। সেইসঙ্গে স্থানীয় অতিবৃষ্টি পানির স্তর বাড়িয়ে দিয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় এবং সাগরের নিম্নচাপে বন্যার গভীরতা ও ব্যাপ্তি হয়েছে বেশি। এর আকস্মিকতার কারণ অবশ্য ভিন্ন। উজানে ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধের কপাট খুলে দেওয়ায় পানির স্তর বৃদ্ধি পায় ভাটির অঞ্চলে। এর কোনো পূর্বাভাস বা সতর্কীকরণ ছিল না। ফলে আমাদের জানমালের ক্ষতি হয়েছে বেশি। এর আগে উনিশ শতকে এ দেশে প্রলয়ংকরী বন্যা হয়েছে মোট ছয়বার। বিশ ও একুশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভয়াবহ বন্যা হয়েছে ১৮ বার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমরা বড় বন্যা দেখেছি ১৯৭৪, ১৯৮৪, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৭ ও ২০১৬ সালে। প্রতিবারই বন্যা শেষে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। এগিয়ে গেছে অর্থনীতি। এবার ২০২৪ সালের বন্যার পরবর্তী সময়েও তার ব্যতিক্রম হবে না আশা করা যায়।
বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এ দেশে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ও পাহাড় ধসের মতো বড় দুর্যোগ প্রায়ই আঘাত হানছে। তাতে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। অনেক প্রাণহানি ঘটছে, অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। এসবের জন্য পরিসংখ্যান হালনাগাদ সংরক্ষণ, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস ও অভিযোজনের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের জন্য বাজেট প্রণয়ন, অর্থায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন ইত্যাদি এখন সময়ের দাবি। এসব লক্ষ্য অর্জনে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন উদ্যমে একযোগে কাজ করা উচিত। বন্যা যেন ক্ষতির কারণ না হয়ে আশীর্বাদ হয়, সেজন্য আমাদের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে খাল খনন কর্মসূচি হাতে নিয়ে দেশের অর্থনীতি ও কৃষিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী এ ধারণা প্রয়োগের প্রথম ধাপে কৃষিতে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। দেশের ইতিহাসে ওই সময়কে সবুজ বিপ্লবের কাল বলে উল্লেখ করা হয়। জিয়াউর রহমান প্রাকৃতিক জলাধার সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশে খাল খনন কর্মসূচি শুরু করেন। সমাজকে সংগঠিত করার এক অনন্য নজির হচ্ছে খাল খনন কর্মসূচি। এই কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করা হয়। আপাতদৃষ্টে এ কর্মসূচিকে শুধুই খাল খনন মনে করা হতো। কিন্তু এর বহুমুখী উদ্দেশ্য ছিল, যেমন কৃষিতে সেচ নিশ্চিত করা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা। সারা দেশে খাল খনন করে প্রাকৃতিক জলাধার নির্মাণের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে উপরিভাগের পানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। শুষ্ক মৌসুমে এসব খালের পানি সেচকাজে ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া খালগুলোতে মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে দেড় হাজারের বেশি খাল খনন করা হয়। দৈর্ঘ্যে প্রায় ২৬ হাজার কিলোমিটার খাল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খনন ও পুনঃখনন করা হয়। খাল খনন ছিল এক ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব। ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী একতাবদ্ধ হয়। দল বেঁধে খাল খনন করা তাদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে উদ্বুদ্ধ করে। একজন রাষ্ট্রপতির কোদাল নিয়ে নিজ হাতে খাল খনন ছিল ইতিহাসের বিরল দৃষ্টান্ত। আর এ কারণেই খাল খননের সরাসরি প্রভাব পড়ে কৃষিতে। খালের মাধ্যমে কৃষিতে সেচ দেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এটা অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যের সেচ সুবিধা ছিল কৃষকদের জন্য। ফলে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় বহন করতে হয়নি কৃষকদের। ইতিহাস ঘাঁটলে আরও দেখা যায়, ১৯৭৪ থেকে ’৭৫ সালে মোট ৩২ লাখ ২ হাজার ২৫০ একর জমি সেচের আওতায় ছিল। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৩৯ হাজার ১৩০ একর জমিতে পাওয়ার পাম্প ও টিউবওয়েলের মাধ্যমে সেচ দেওয়া হতো। আর ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ১২০ একর জমিতে প্রচলিত পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া হতো। খাল থেকে সেচ দেওয়া হতো মাত্র ২ লাখ ৯৩ হাজার ৮৪০ একর জমিতে। ১৯৮১ থেকে ’৮২ সালে দেশে মোট সেচের আওতায় আসা জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩৭ একর। ওই সময় খাল থেকে সেচ দেওয়া জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ৩ হাজার ৫১৫ একর।
শুধু সেচের আওতাই বৃদ্ধি নয়, গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য সহায়তারও পথ খুলে দেয় খাল খনন কর্মসূচি। কার্যত খাল খনন কর্মসূচি একসঙ্গে অনেক সাফল্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত কর্মসূচি ছিল। এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ওই সময়ে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল বেশি। মানুষের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেওয়াই ছিল চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে খাল খনন কর্মসূচি বিরাট ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তাই টেকসই বন্যা মোকাবিলায় আবারও খাল খনন কর্মসূচি ফিরিয়ে এনে খাদ্য নিরাপত্তার জায়গাটি আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে। তাহলেই দেশ আবারও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।
লেখকদ্বয়: কৃষি গবেষক ও বিশ্লেষক
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়