আমি মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণিকে কোনোদিন দেখিনি, তাকে চিনি না, এমনকি আমি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেরও অফিসার নই। তার সম্বন্ধে আমার জ্ঞান কেবল খবরের কাগজভিত্তিক, তবুও মনে করি যে, আমরা তার ব্যাপারে সঠিক মূল্যায়ন করিনি বা করতে পারিনি বা করতে চাইনি বা করতে দেওয়া হয়নি। করতে দেওয়া হয়নি বলছি এই কারণে যে, আমরা লর্ড মেকলের পরশ্রীকাতর গোত্রের লোক। সেই অনুসারে আমরা কারও ভালো হোক বা সুনাম হোক, তা কোনোদিন পছন্দ করি না। তবে তার সম্বন্ধে কেনো সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি, তা বলতে পারব না। এখানে আমার চিন্তাধারা তুলে ধরছি, এই লেখা ও মতাদর্শ একান্ত আমার নিজস্ব।
মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় ১ ডিসেম্বর ১৯১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতা অর্থনৈতিক দিক থেকে সচ্ছল না হওয়ায় তাকে ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার জন্য অনেক ঝড়ঝাপ্টার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে অনেক সহৃদয় ব্যক্তি এগিয়ে আসায় তার পড়ার কোনো ব্যাঘাত হয়নি। তিনি কম বয়স থেকেই বিভিন্ন বয়সের ছেলেদের সংগঠিত করেছেন। আমি মেজর গণির সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পূর্বেকার ইতিহাস লিখব না, কারণ সে সম্বন্ধে অনেক লেখালেখি হয়েছে এবং তা আমার এই লেখার বিষয়বস্তুও নয়। আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে তাকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করব।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে বাঙালিদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। কাজেই ব্রিটিশরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ দেবে না। সেবা শাখাতে (Service Corps) ছিটেফোঁটা নিলেও যুদ্ধ শাখাতে (Fighting Corps) মোটেই রাখবে না, রাখলেও খুবই নগণ্যসংখ্যক। সিপাহি বিদ্রোহ থেকে এ শিক্ষা পেয়েছিল যে, বাঙালিদের সেনাবাহিনীতে রাখলে তারা বিদ্রোহের বীজ বপন করবে, যা তাদের ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করতে অসুবিধা সৃষ্টি করবে। মেজর গণি পদাতিক শাখায় কমিশন পেয়েছিলেন কিন্তু তাকে প্রথামতো কোনো পদাতিক রেজিমেন্টে পদায়ন (Posting) না করে সহায়ক (Auxiliary) সৈনিকদের শাখায় নিযুক্ত করা হয়। সেবা শাখায় কিছু বাঙালি থাকলেও যুদ্ধ শাখায় মোটেই ছিল না। যে কয়েকজন ছিলেন, তার মধ্যে বাঙালি মুসলমান ছিল না বললেই চলে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় পাকিস্তানের অংশের সশস্ত্র বাহিনীর সংগঠনগুলোতে শুধু পাঞ্জাবি ও পাঠান ছিল। বাঙালিদের সংখ্যা একেবারেই তলানিতে, বেলুচদের সংখ্যা তারও কম এবং সিন্ধু প্রদেশের কেউ ছিল বলে মনে হয় না। এ সুযোগে পাঞ্জাবি ও পাঠান কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে, তাদের এলাকা অর্থাৎ পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশ ছাড়া অন্য প্রদেশ থেকে লোক সেনাবাহিনীতে নেওয়া চলবে না, বিশেষ করে বাঙালিদের। বাঙালিদের নিলে তারা সংখ্যানুপাতে তাদের ভাগ চাইবেন, তাতে পাঞ্জাবি এবং পাঠান এলাকার কমসংখ্যক লোক চাকরি পাবে। তারা যোদ্ধা (Martial Race) জাতি নয়, এই বলে কম বাঙালি নেওয়া হবে।
এখানে আমাদের সময় বা তার পূর্বে জ্যেষ্ঠ এবং কনিষ্ঠ অফিসারদের মধ্যে সম্পর্কের একটা চিত্র তুলে ধরব শুধু এটুকু বোঝানোর জন্য যে, একজন কনিষ্ঠ সেনা অফিসারের অবস্থান সেনা অফিসার গোষ্ঠীতে কোথায়? তাতেই বুঝতে পারা যাবে মেজর গণির জন্য কত মুশকিলের কাজ ছিল তার পরিকল্পনা সম্পাদন করা। সেনা অফিসারদের মধ্যে একটা বহু প্রচলিত বচন আছে যে—‘A junior officer to be seen only and not to be heard’ অর্থাৎ ‘একজন কনিষ্ঠ অফিসারকে শুধু দেখা যাবে, তার গলার আওয়াজ শোনা যাবে না।’ এ ছাড়া জ্যেষ্ঠ অফিসাররা অনেকটা ঈদের চাঁদের মতো ছিলেন। তাদের দেখা-সাক্ষাৎ পাওয়া ছিল দুরূহ ব্যাপার। যেখানে দেখা হওয়ার এ অবস্থা, সেখানে মেজর গণির পক্ষে সেই দুর্ভেদ্য অবস্থায় কোনো কিছু করানো সহজ কাজ ছিল না। তার ওপর কোনো কিছুর অনুমোদন দেওয়া সরকারের কাজ, সেনাপ্রধানের নয়। কেন্দ্রে জিন্নাহ সাহেবের সরকার। তাকে জানানো হয় যে, সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবি, পাঠান, বাঙালি ও বেলুচিস্তানের সদস্য আছে এবং তাদের নামে সেনা দল আছে (Regiment); যেমন পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, পাঠান রেজিমেন্ট, বেলুচ রেজিমেন্ট তবে বেঙ্গল রেজিমেন্ট নেই। জিন্নাহ সাহেবের রাজনৈতিক চমক এবং মেজর গণির প্রবল ইচ্ছার সংমিশ্রণের ফল ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৃষ্টি। তবে এর মানে এই নয় যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব সদস্যই বাঙালি হবেন, যেমন বেলুচ রেজিমেন্টে বেলুচিদের সংখ্যা অত্যন্ত কম, সব পাঞ্জাবি ও পাঠানে ভর্তি। তবে মনে করি মেজর গণি চেষ্টা না করলেও একদিন বেঙ্গল রেজিমেন্ট হতো কর্তাব্যক্তিদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে। মেজর গণির জন্য তা ত্বরান্বিত হয়েছে। জিন্নাহ সাহেবের সরকার সেনাপ্রধানকে আদেশ দেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করার জন্য।
মেজর গণিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সংগঠন করার। রেজিমেন্টের জন্য বাঙালি সৈনিক পাওয়া গেল পাইওনিয়ার কোর থেকে, কিন্তু অফিসার? বাঙালি অফিসার নেই, তাই সেই অবাঙালি অফিসারদের ওপর নির্ভর হতে হলো। মেজর গণি বাঙালি অফিসারদের দুষ্প্রাপ্যতা সম্বন্ধে জানতেন এবং তার কারণও।
মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ অগণিত সর্বস্তরের দেশবাসীর অংশগ্রহণে, যারা যুদ্ধের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন তারা জানতেন যে, সেনাবাহিনী তথা বেঙ্গল রেজিমেন্টই দিতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব। কারণ এরাই যুদ্ধের জন্য সংগঠিত এবং এদের দায়িত্বে ছিলেন বাঙালি অফিসাররা, যাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন অন্যান্য শাখার কিছু বাঙালি অফিসার। বাঙালি অফিসার না হয়ে অবাঙালি অফিসাররা নেতৃত্বে থাকলে যুদ্ধই হতো না, মুক্তি তো পরের কথা। যেমন বেলুচিস্তানে বেলুচরা স্বাধিকারের জন্য সংগ্রাম করছে। সেখানে বেলুচ রেজিমেন্টও অংশ নিচ্ছে কিন্তু বেলুচদের বিরুদ্ধে, কারণ তাতে বেলুচ অফিসার বা সৈনিকের সংখ্যা অতি নগণ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ রাইফেলসের যে যে ব্যাটালিয়নে বাঙালি অফিসাররা দায়িত্বে ছিলেন, সেগুলো সম্পূর্ণ ব্যাটালিয়ন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল কিন্তু যেখানে অফিসাররা অবাঙালি ছিলেন, সেসব ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা ব্যক্তিগতভাবে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কাজেই বাঙালি ব্যাটালিয়নে বাঙালি অফিসারদের নেতৃত্বই ছিল মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হওয়ার একটা বড় কারণ। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৃষ্টি ছিল মেজর গণির বড় সফলতা। তবে তার চেয়েও অনেক বড় কৃতিত্ব ছিল বাঙালি অভিভাবক এবং যুবকদের মন থেকে সেনাভীতি বা আতঙ্ক দূর করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়াতে অনুপ্রাণিত করানো। কারণ তিনি প্রারম্ভিক অবস্থাতেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, অফিসার ছাড়া কোনো সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যে বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর গণি গঠন করেছিলেন এবং বাঙালি অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত করার ব্যবস্থাও করেছিলেন, সেই বেঙ্গল রেজিমেন্টই যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল। তারাই যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করে এবং এর ওপরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংগঠিত হয়েছে বা হচ্ছে। কাজেই আমি যদি বলি, মেজর গণি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্থপতি; সেটা অত্যুক্তি হবে কি?
[মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণির প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে প্রয়াত সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. এম আতিকুর রহমানের নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]