কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ এএম
আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কালবেলাকে বিশেষ সাক্ষাৎকার

১৫ বছরের লুটপাট পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল

যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের গুপ্তা কলেজ অব বিজনেসের অ্যাডজাঙ্কট ইনস্ট্রাক্টর অব বিজনেস অ্যানালিস্ট শাফকাত রাব্বী অনীক (ডানে)। ছবি : সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের গুপ্তা কলেজ অব বিজনেসের অ্যাডজাঙ্কট ইনস্ট্রাক্টর অব বিজনেস অ্যানালিস্ট শাফকাত রাব্বী অনীক (ডানে)। ছবি : সংগৃহীত

শাফকাত রাব্বী অনীক যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের গুপ্তা কলেজ অব বিজনেসের অ্যাডজাঙ্কট ইনস্ট্রাক্টর অব বিজনেস অ্যানালিস্ট। এ ছাড়া তিনি ডালাসের একটি বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ট্রেজারি বিভাগের বিশ্লেষণী দলের প্রধান। কর্নেল ইউনিভার্সিটি, এনওয়াই থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং মিয়ামি ইউনিভার্সিটি, এফএল থেকে সিস্টেম অ্যানালাইসিসে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডিস ইনদ ভেস্টর সার্ভিস, নিউইয়র্কে মর্টগেজ এবং বন্ড ইন্স্যুরেন্স শিল্পের পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ডভিত্তিক অ্যাসেট-ব্যাকড সিকিউরিটিজ শিল্পের বিশ্লেষক হিসেবে যোগদান করেন। সম্প্রতি দেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান, অর্থনীতি, ব্যাংক ও আর্থিক খাত, সংস্কারসহ নানা বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন

কালবেলা: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই গণঅভ্যুত্থান আমাদের জন্য কী বার্তা বহন করছে?

সাফকাত আনিক: বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে একটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। সারা দেশে লাখ লাখ মানুষ বন্দুকের নল, গ্রেপ্তার, হামলা ও নির্যাতনের ভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে এসেছে। হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে, রক্ত ঝরেছে এবং দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ জীবন দিয়েছে। আমরা দেখেছি কীভাবে শত শত মানুষ স্বৈরশাসকের বন্দুকের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছে, আমরা দেখেছি একজন গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর আরেকজন কীভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা জনতার মিছিল দেখেছি, যে মিছিলে কাউকে জোর করে আনা হয়নি। আমরা সেই মিছিল দেখেছি, যে মিছিল স্বৈরাচারের সব শক্তিকে পদানত করে স্বৈরাচারকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে ছেড়েছে। এই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিহাস হয়ে রইল। ইতিহাস হয়ে রইল পৃথিবীতেও। এই আন্দোলন আমাদের প্রধান যে বার্তা দেয় তা হলো—অন্যায়, অবিচার ও চুরি করে বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ এবং তার সুবিধাভোগীরা এক ধরনের অরাজকতা চালিয়ে গেছে। দখল, দুর্নীতি, চুরিসহ নানাভাবে তারা ব্যাপকভাবে লুটপাট করেছে। আমার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিইও পর্যায়ের কিছু ব্যক্তির সঙ্গে কথা হতো, যারা আমেরিকায় তাদের প্রতিষ্ঠানের ফান্ড রেইজ করতে আসত। আমি তাদের প্রশ্ন করতাম, আপনারা এভাবে টিকে আছেন কেমন করে? তারা বলত, চীন এভাবে চলছে। আমি বলেছি, আপনারা যেভাবে অসদুপায় অবলম্বন করে এসব করছেন, চীনে তেমনটা হয় না। কিন্তু তারা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতেন, চীন এভাবে অনেক ওপরে চলে গেছে, আমরাও যাব। মূলত বাংলাদেশের অলিগার্কদের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে, চুরি করে, দখলবাজি করে, ব্যাংক লুট করে তারা টিকে থাকবে। তাদের এই আত্মবিশ্বাস আওয়ামী লীগ সরকারকে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রেখেছে। তাদের মধ্যে এই কনফিডেন্স না থাকলে আওয়ামী লীগের হয়তো আরও আগে পতন হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের এই সুবিধাভোগীরা এখন জান নিয়ে দৌড়াচ্ছে। কেউ কলাপাতায় শুয়ে আছে, কেউ চুরি করে বর্ডার পার হতে গিয়ে গুলি খাচ্ছে। এ পরিস্থিতিটাই আমাদের জন্য প্রধান বার্তা। এ পরিস্থিতিটা আমাদের বার্তা দেয় যে, চুরি, অন্যায়, অবিচারের একটি লিমিট থাকতে হবে। বাংলাদেশে এই লিমিটটা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা ভেবেছিল কোনো লিমিট ছাড়াই অন্যায় এবং লুটপাট করা যাবে। এই গণঅভ্যুত্থান তাদের ওপরে একটি লিমিট সেট করে দিয়েছে। শুধু ব্যবসায়ী নন; পুলিশ, বিচারক, আমলা সবার জন্যই এ গণঅভ্যুত্থান একটি লিমিট সেট করে দিয়েছে।

কালবেলা: গত ১৬ বছরে আমরা যত দুর্নীতি ও অনিয়ম দেখেছি তার বেশিরভাগই হয়েছে রাজনীতিকে আশ্রয় করে বা রাজনীতিকে ব্যবহার করে। এ অবস্থা থেকে রাজনীতিকে কীভাবে বের করে আনা যেতে পারে বলে মনে করেন?

সাফকাত আনিক: বাংলাদেশের সব মানুষের এই একটাই প্রশ্ন—কীভাবে দেশটা ঠিক হতে পারে। কীভাবে দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ হতে পারে। বাংলাদেশে লেখালেখি করেন বা টকশো করেন এরকম ‘টকিং ক্লাস’ মানুষের সবারই দেশের এই দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করার ব্যাপারে অনেক দীর্ঘমেয়াদি এবং নানা ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে আমি মনে করি এত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কোনো প্রয়োজন নেই। যদি প্রথমেই দেশের বিচার ব্যবস্থা ঠিক করা যায় এবং বিচার ব্যবস্থাকে যথেষ্ট শক্তিশালী করা হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিচার ব্যবস্থার এতটুকু কনফিডেন্স থাকতে হবে যে, আদালতের একটি রায় বাস্তবায়ন করার জন্য দেশের পুলিশ প্রশাসন বাধ্য থাকবে। দেশের বিচার ব্যবস্থায় এটুকু নিশ্চিত করতে হবে যে, মিথ্যা বললে জেলে যেতে হবে, চুরি করলে জেলে যেতে হবে এবং খুন করলে জেলে যেতে হবে। এই তিনটি বেসিক হিউম্যান ডিগনিটির বিচার যদি স্পষ্ট হয়, তাহলেই দেশের অপরাধ ৯০ ভাগ কমে যাবে। বিচার ব্যবস্থাকে এটুকু নিশ্চিত করতে হবে যে, মানুষ একটি মামলা দিলে সেই মামলা গ্রহণ করা হবে। এই থিউরিটারই গাল ভরা নাম হচ্ছে রুল অব ল। অর্থাৎ আইন দিয়ে শাসনকে এস্টাবলিশ করা। দেশের আইনকানুন পার্লামেন্ট দিয়ে পরিবর্তন করা যায়। কিন্তু মিথ্যা, চুরি এবং খুন—এ তিনটি বিষয় যে অপরাধ, সেটা পার্লামেন্ট দিয়েও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সুতরাং এই তিনটি বিষয় অপরাধ হিসেবে গ্রহণ করলেই দেশে কোনো সিস্টেমেটিক ক্রাইম আর থাকবে না। রাজনীতির আশ্রয় নিয়েও আর কেউ দুর্নীতি ও অপরাধ করতে পারবে না।

কালবেলা: গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন দেখছেন?

সাফকাত আনিক: গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অর্থনীতি পৃথিবীর কোনো দেশেই ভালো থাকে না এবং বাংলাদেশেও সেটা থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। মূলত এই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের পুরো সিস্টেমটাই ওলটপালট হয়ে গেছে। যারা স্বৈরশাসনের সুবিধাভোগী ছিল, তারা এখন পালিয়ে গেছে। যারা দেশে রয়েছে তারাও এখন কোনো দলে কীভাবে জায়গা করে নেবে, সেটা নিয়েই ব্যস্ত। ফলে দেশের অর্থনীতি এখন অনেকটা এলোমেলো, যা স্থিতিশীল হতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। একটি দেশের অর্থনীতির মূল উপাদান হলো কনফিডেন্স। এমন নয় যে হাসিনার আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক কনফিডেন্স ছিল, সেটা ছিল না; কিন্তু অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল। চোরে-চোরে মিলে একটি সিস্টেম একভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আর এখন সেই চোরদেরও কোনো কনফিডেন্স নেই। সুতরাং গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অর্থনীতি ভালো থাকার কথা না এবং নেইও। আমরা প্রথমেই এ বিষয়টা পরিষ্কার করে নিচ্ছি; কারণ আমাদের এমনটা আশা করা উচিত নয় যে, হাসিনাকে বিতাড়িত করার পর নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে সবকিছু এক দিনে ঠিক করে ফেলবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সরকারের সামনে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ আসবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠতে হবে।

কালবেলা: ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করবে আনুষ্ঠানিকভাবে। এটা কি আমাদের অর্থনীতিতে কোনো চাপ তৈরি করবে কী?

সাফকাত আনিক: বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে আমাদের হাতে নেই। একই সঙ্গে এগুলো নিয়ে আমাদের কোনো কাজও নেই। যেমন একটি হলো, জলবায়ু পরিবর্তন। আগামী ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের যে পরিমাণ সাংঘাতিক প্রভাব পড়বে, তা কি আমরা মোকাবিলা করতে পারব? অনেক গবেষণায় বলা হচ্ছে, আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশের মোট ভূমির পাঁচ ভাগের দুই ভাগ পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যাবে, অনেকে বলেন ১৫ ভাগ পানিতে নিমজ্জিত হবে। যদি এমনটা ঘটে তাহলে লাখ লাখ মানুষ সেসব এলাকা থেকে ওপরের দিকে চলে আসবে। এটা বাংলাদেশের জন্য খুবই সিরিয়াসভাবে চিন্তা করার একটি বিষয়। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো কাজ এখনো আমরা দেখিনি। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই আমাদের অর্থনীতি বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে। এ ছাড়া আমাদের সামনে অন্যান্য অনেক সংকট রয়েছে। যেমন আমাদের জনশক্তির বেশিরভাগই অদক্ষ শ্রমশক্তি হিসেবে রয়ে গেছে। এখনো আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে কম মজুরির কাজগুলো করি। এই কাজগুলো আগামী ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে রোবোটাইজ হয়ে যাবে। এমনকি গার্মেন্টসের সেলাইয়ের কাজও রোবোটিক সিস্টেমে করা হবে। তাহলে আমাদের লাখ লাখ গার্মেন্টস কর্মীর কী হবে? এ ধরনের অনেক সমস্যা রয়েছে, যেগুলো বিএনপি বা আওয়ামী লীগের তৈরি করা নয়। এ সিস্টেমেটিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য যে ধরনের আগাম প্রস্তুতি বা কাজের দরকার ছিল গত রেজিমে সেটা হয়নি। অথচ ২০৩০-৩৫ সাল নাগাদ এগুলো আমাদের অর্থনীতিতে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে। আমাদের ব্যাংকিং খাত ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আমরা আগে জানতাম মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা চুরি করে। কিন্তু এখন দেখা যায় ব্যাংক থেকে টাকা নয় বরং পুরো ব্যাংকটাই চুরি করে নিয়ে গেছে। দেখা গেছে, একজন ব্যক্তিই একটি ব্যাংক খেয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে যেভাবে লুটপাট চালানো হয়েছে সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আমাদের যে অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তাও খুব একটা কার্যকর নয়। আমাদের বিরাট বৈদেশিক ঋণের বোঝা তৈরি হয়েছে এবং তার কিস্তি পরিশোধও শুরু হয়েছে। সব মিলে আমাদের অর্থনীতি প্রকৃতপক্ষেই অনেক চাপের মধ্যে রয়েছে। এ মুহূর্তে আমরা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করলে ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারে যে শুল্কমুক্ত সুবিধাগুলো পাই, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আমাদের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য আরও সময় বাড়িয়ে নেওয়া প্রয়োজন।

কালবেলা: বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাগুলো কী এবং এগুলো কাটিয়ে উঠতে কী করা যেতে পারে বলে মনে করেন?

সাফকাত আনিক: প্রথমত আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যে সমস্যাগুলো ফেস করছি, সেগুলো পৃথিবীর অনেক দেশ ৭০ থেকে ৮০ বছর আগে সমাধান করে ফেলেছে। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের মতো চুরি অন্য কোনো দেশে হয় না। তবে বাংলাদেশ এমন কোনো দ্বীপ রাষ্ট্রও নয়, যে এখানে সবকিছু এতটাই ডিফারেন্ট যেখানে কোনো আইনকানুন কাজ করে না। পৃথিবীর যে কোনো একটি ভদ্র দেশের রুলস রেগুলেশনগুলো যদি বাংলাদেশে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে আমাদের সিস্টেমটাই পরিবর্তন হয়ে যাবে। অনেক ভুল ত্রুটি হতে পারে; কিন্তু কোনো না কোনোভাবে সিস্টেম দাঁড়িয়ে যাবে। পৃথিবীর যে কোনো একটি সিস্টেমের মূল এথিক্সগুলো খুবই সিম্পল। মিথ্যা বলা যাবে না, চুরি করা যাবে না, আইন ভাঙ্গা যাবে না—এগুলোই সব সিস্টেমের মূল। যুক্তরাষ্ট্রের সিস্টেম হলো, কোনো একটি ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টে যদি মিথ্যা লেখা থাকে, তাহলে সেই মিথ্যার কারণে পুরো এক্সিকিউটিভ সুইট জেলে যায়। তাদের বিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়। যদি একটি সিস্টেমে এটা প্রতিষ্ঠিত করা যায় যে, কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় নথিতে মিথ্যা লেখা যাবে না, তাহলে পুরো সিস্টেমটাই পরিবর্তন হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো সরকারি কর্মকর্তা কোনো মিথ্যা স্টেটমেন্টে কোনোভাবেই সাইন করতে রাজি হয় না। তারা মিথ্যাকে প্রচণ্ড ভয় পায়। কারণ সেখানে এই অপরাধের শাস্তি অনেক বড় এবং সেই শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। এমনকি আমি যুক্তরাষ্ট্রে একটি ব্যাংকে চাকরি করি, আমার চুক্তিতে লেখা রয়েছে যে, আমি যদি পার্সোনালি কোনো মিথ্যা বলি, তাহলে তারা আমাকে দেওয়া বেতন এবং বোনাসের ছয় বছরের সমপরিমাণ অর্থ ফেরত চাইতে পারে। এর মানে এটা নয়—আমেরিকায় কেউ মিথ্যা বলে না। সেখানে অনেকে মিথ্যা বলে এবং তার জন্য জেলেও যায়। তবে মূল পয়েন্টটি হলো, বেশিরভাগ মানুষ এটা করতে পারে না, কারণ তাদের সামনে রয়েছে জরিমানা এবং শাস্তির ভয়। আমাদের দেশেও আমরা যদি অর্থ ব্যবস্থাপনায় সংস্কার চিন্তা করি, তাহলে প্রথমেই মিথ্যা বলা বন্ধ করতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে হবে যেন সিস্টেমেটিক্যালি কেউ মিথ্যা বলতে না পারে। আর এরপর, এজেন্সি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনতা দিতে হবে। আমাদের বিদ্যমান আইনকানুনগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। শুধু মিথ্যা, খুন এবং চুরি—এ তিনটি জিনিস বন্ধ করা গেলে সমাজের সব সেক্টর লাইনে চলে আসবে।

কালবেলা: বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য করণীয় কী?

সাফকাত আনিক: বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন আইনের শাসন নিশ্চিত করা। আমরা দেখেছি, হাসিনার আমলে বলে বেড়ানো হতো, আমরা সারা পৃথিবীর মধ্যে উন্নয়নের রোল মডেল। যেখানে উন্নয়নের রোল মডেলের একটি সংজ্ঞা হলো, আপনি যখন উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে যাবেন, তখন আপনার উন্নয়ন দেখার বা উপভোগ করার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে ক্রেডিবল আর্থিক কোম্পানিগুলো সেখানে চলে আসবে। অথচ গত ১৫ থেকে ২০ বছরে বাংলাদেশে পৃথিবীর কোনো বড় বিদেশি কোম্পানি আসেনি। কোনো ভালো বিদেশি ব্যাংক আসেনি। কোনো বড় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি আসেনি। এমনকি ছোট ছোট দুই একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই বাংলাদেশ কার্যক্রম পরিচালনা করছিল, তারাও তাদের কার্যক্রম সীমিত করে নিরাপদ জায়গায় এসে বসে আছে এবং মুনাফা নিয়ে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেন আসছে না—এ প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। এর প্রথম উত্তর হলো, বাংলাদেশের সিস্টেম তারা বিশ্বাস করতে পারেনি। আমেরিকায় একটি আইন রয়েছে, ফরেন অফিসার করাপশন অ্যাক্ট। অর্থাৎ আমেরিকার কোনো সরকারি বা বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা যদি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে গিয়ে সেখানের কোনো অফিসারকে ঘুষ প্রদান করে এবং সেটা যদি কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জেনে যায়, তাহলে সেই অফিসারকে যুক্তরাষ্ট্রেই শাস্তি দেওয়া হবে। পশ্চিমা দেশগুলোর এই ‘ফেয়ার নীতি’র কারণে তারা চিন্তা করে, আমরা বাংলাদেশে কাজ করতে যাব এবং সেখানে ঘুষ দিয়ে ধরা খেয়ে শাস্তির মুখে পড়ব! কী দরকার সেখানে যাওয়ার! বাংলাদেশে উন্নত বিশ্বের কোনো সফিস্টিকেটেড ইনভেস্টমেন্ট আসে না, তার মূল কারণ এখানে আইনের শাসন নেই। তারা যদি বলে, আমি ঘুষ না দিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা করব, সেটা বাংলাদেশের সিস্টেমে সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রথমেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ঘুষ ও দুর্নীতি থামাতে হবে। শুধু গাল ভরা কথা দিয়ে নয়, প্রকৃতপক্ষেই যদি আমরা রুল অব ল প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলেই বাংলাদেশে প্রত্যাশিত বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ এলে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।

কালবেলা: আমাদের আর্থিক খাত এবং ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এটাকে ঠিক করার জন্য কোনো বৈশ্বিক মডেল রয়েছে কি?

সাফকাত আনিক: ২০০৮ সালে যখন আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয় তখন সরকার কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ সংকটকে সামাল দিয়েছিল। সরকার তখন যে কাজগুলো করেছিল তার মধ্যে একটি হলো, কিছু প্রতিষ্ঠানকে সরকার ভেঙে পড়তে দিয়েছিল। অন্তত একটি উদাহরণ তৈরি করার জন্য হলেও এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো ধরনের সুবিধা না দিয়ে পড়ে থাকতে দেওয়া হয়। যেমন, ল্যামান ব্রাদারস নামে একটি বড় ব্যাংককে রিকভার না করে নষ্ট হতে দেওয়া হয়। যাতে অন্যরা সাবধান হয়ে যায়। একই সময়ে অন্য কয়েকটি সংকটে থাকা ব্যাংককে জোরপূর্বক ভালো ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত করে দেওয়া হয়। একীভূত করার পর এই ব্যাংকগুলোকে চালানোর জন্য প্রয়োজন মতো অর্থ সরবরাহ করে সরকার। শর্ত ছিল ব্যাংকগুলো যখন ভবিষ্যতে ভালো হয়ে যাবে এবং মুনাফা করবে তখন সরকারের দেওয়া অর্থ আবার ফেরত দেবে। মার্কিন সরকার এ সময় দ্বিতীয় যে কাজটি করে তা হলো, ব্যাংকের ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করে দেয়। এর ফলে ব্যাংক সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত না পেলেও একটি বড় অংশ ফেরত পায় এবং নতুন মালিকের হাতে প্রতিষ্ঠানগুলো যখন রান করে, তখন অর্থনীতিতে তা ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে নতুন যে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানটি ক্রয় করে নেয় তার জমিয়ে রাখা টাকাটাও হাতবদল হতে থাকে। অনেক প্রতিষ্ঠান যখন এভাবে বিক্রি হয়ে যায়, তখন নতুন একটি শ্রেণি তৈরি হয়। যারা তাদের টাকা জমিয়ে রেখেছিল, সেই টাকা তখন বাজারে আসে। সবকিছু মিলে দেশের অর্থনীতির লাভ হয়। অন্যদিকে আমাদের দেশে রুগণ প্রতিষ্ঠানগুলো কন্টিনিউ করতে দেওয়া হয়। তারা বারবার লোন রি-স্ট্রাকচার করতে থাকে। তাদের সময় বাড়ানো হতে থাকে এবং একই সময়ে সুদ মওকুফ করা হতে থাকে। এর ফলে একটি ব্যাড বিহেভিয়ারকে ইনসেনটিভ দেওয়া হয়। একদল চোরকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। এটা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা প্রয়োজন। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপিতে পড়ে এবং বছরের পর বছর ধরে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে না পারে; তাহলে সেটা কন্টিনিউ করতে না দিয়ে একটি সময়ে ব্যাংকের উচিত প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেওয়া। হতে পারে দুই বছর, চার বছর বা পাঁচ বছর—এরপর প্রতিষ্ঠানটির অ্যাসেট বিক্রি করে দেওয়া উচিত। এর ফলে নতুন মালিক প্রতিষ্ঠানটি চালাবে এবং সেটা অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। বছরের পর বছর ধরে ব্যাংকের টাকা আটকে রাখার প্র্যাকটিস বন্ধ করতে হবে। আমেরিকায় এ নিয়মটি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। একই মডেল অনুসরণ করা হয় উন্নত দেশগুলোতেও।

কালবেলা: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

সাফকাত আনিক: যেহেতু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নয়, সুতরাং তারা বিভিন্ন দিক থেকে অনেক বেশি ডিস্টার্বের সম্মুখীন হবে এবং হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমার পরামর্শ হবে, তারা যেন খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের যে লেজিটিমেট পলিটিক্যাল ফোর্সেস রয়েছে তাদের মধ্যে যারা খুন, মিথ্যা এবং চুরির সঙ্গে জড়িত নয়; সেই গোষ্ঠীগুলোকে আমলে নেয়। তাদের যেন কোনো একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে এসে বাংলাদেশের সামনে আসতে যাওয়া রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় কাজে লাগায়। সরকারের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, তারা যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে আসে। একটি অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকা উচিত নয়। আদর্শভাবে, বারো মাসের বেশি নয়। আমাদের কাছে পূর্ববর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য রয়েছে যা দেখায় যে, অর্থপূর্ণ সংস্কারগুলো তুলনামূলকভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যেমন, লতিফুর রহমানের আমলে প্রথম রাতেই ৩৫ জন সচিবকে বদলি করা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ৩৫টি মন্ত্রণালয় পুনর্গঠন করা হয়। সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপের এই স্তরটি প্রত্যাশা করা উচিত, তবুও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এমন পদক্ষেপ নেয়নি। অগ্রগতির অভাব জনগণের মধ্যে ট্রমা এবং ভয়ের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী করা যেতে পারে। আমরা চাই না এর আগের এক-এগারোর সরকার যে কারণে ব্যর্থ হয়েছিল, সেই একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি আবার হোক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে, রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে বসে এবং তাদের পরামর্শ নিয়ে দেশকে কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়, সেটার পথ খুঁজে বের করা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বাস পেলেন বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থীরা

ভাইবোনদের সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ জামায়াত কর্মীর বিরুদ্ধে

সিকদার গ্রুপের ২০৩ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ 

যে কারণে কনসার্ট থেকে বাদ ন্যান্সি

নারায়ণগঞ্জ / আন্দোলনে শহীদ পরিবার ও আহতদের আড়াই কোটি টাকা অনুদান প্রদান

নির্বাচিত সরকার ছাড়া কোনো সংস্কারই সম্ভব নয় : রহমাতুল্লাহ

ভারতের একাধিক চেকপোস্ট গুঁড়িয়ে দিল পাকিস্তানের সেনারা

ইরান দূতাবাসের শোক বইয়ে জামায়াত সেক্রেটারির স্বাক্ষর

ভর্তি পরীক্ষায় পাস করলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করার সুপারিশ

১০

নির্বাচনে জোট গঠন নিয়ে যা জানালেন নাহিদ ইসলাম

১১

মোহাম্মদপুর-বছিলা এলাকায় যানজট নিরসনে ডিএমপির আট নির্দেশনা

১২

জ্বালানি তেলের নতুন দাম নির্ধারণ

১৩

বিচার চলাকালীন আ.লীগের নিবন্ধন স্থগিত করতে হবে : নাহিদ ইসলাম

১৪

‘সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচনের সুযোগ নেই’

১৫

স্বৈরাচারের দোসরদের বিচারের দাবিতে ঢাবি ছাত্রদলের বিক্ষোভ 

১৬

‘সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন দিন’ ড. ইউনূসকে মির্জা ফখরুল

১৭

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় / শিক্ষকদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, বদলে গেল উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি

১৮

শুরু হয়েছে ‘মুক্ত সুরের ছন্দ’

১৯

কোকা কোলা বর্জন শুরু করেছে ইউরোপের এক দেশ

২০
X