বাংলাদেশে শীতকাল আসে প্রকৃতির এক অনন্য সৌন্দর্য নিয়ে। হিমেল হাওয়া, স্নিগ্ধ সকাল আর কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতি এক নৈসর্গিক দৃশ্য তৈরি করে। শীতের এ সময়টিতে মাঠে মাঠে শিশিরভেজা ঘাস আর কুয়াশার চাদরে ঢাকা গাছপালা নতুন এক আমেজ এনে দেয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় পিঠাপুলির ধুম লেগে যায়। ভাপা, চিতই, দুধপুলি, পাটিসাপটা—প্রতিটি পিঠার স্বাদ যেন শীতের সকালকে আরও উপভোগ্য করে তোলে। গ্রামাঞ্চলে খেজুরের রস সংগ্রহের উৎসবমুখর পরিবেশ চোখে পড়ে। শহরের মানুষের মধ্যেও নানা আয়োজন দেখা যায়। শীতের বাহারি রকমের উষ্ণ পোশাকে সজ্জিত হয়ে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে বেড়াতে যায় অনেকেই। কেউ শীতের ছুটিতে পাহাড়ে, কেউবা সাগরপাড়ে সময় কাটায়। কিন্তু এই আনন্দঘন শীতকাল সবার জন্য সমান আনন্দ বয়ে আনে না। পথশিশুদের শীতকালে কনকনে ঠান্ডায় টিকে থাকা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তখন মুক্ত আকাশের নিচে রাত কাটানো শিশুদের প্রতিটি দিন একেকটি সংগ্রামের গল্পে পরিণত হয়। তাই এ সময় পথশিশুদের বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ইউনিসেফ বাংলাদেশের সর্বশেষ গবেষণা তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩৪ লাখ পথশিশু রয়েছে, যারা শহরের বিভিন্ন ফুটপাত, রেলস্টেশনে কিংবা বাজারের আশপাশে মানবেতর জীবনযাপন করে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু। তার মধ্যে ১৫ শতাংশ হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু। দিন যতই যাচ্ছে, পথশিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এ পরিসংখ্যান একটি দেশের জন্য অশনিসংকেত। একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এত বড় অংশ যদি এমন দুর্বিষহ অবস্থায় থাকে, তবে তা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পথশিশু বলতে রাস্তায় বসবাস করে। এসব শিশুর সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান বা পারিবারিক নিরাপত্তা নেই। পথশিশু হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য, শারীরিক নির্যাতন, শহরমুখী প্রবণতা, অভিভাবকের পরিচয়হীনতা কিংবা বাবা-মার বিবাহবিচ্ছেদ। ভাগ্যের নির্মম পরিহারে, পথশিশুদের কেউ ফুল বিক্রি করছে, কেউ চা-সিগারেট, আবার কেউ ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। অনেক সময় তারা অপরাধচক্রের শিকার হয়, মাদক কিংবা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। পথশিশুরা বেশিরভাগ সময়ই খালি পায়ে থাকে, পুরোনো কিংবা ছেঁড়া কাপড়ে নিজেদের শরীর ঢেকে রাখে। শীতকালে তাদের উষ্ণ পোশাক ও আশ্রয়ের অভাব দেখা যায়। তখন খাদ্য, পোশাক ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য তাদের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। তাই শীতের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পথশিশুরা কিছু রোগে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, ঠান্ডাজনিত অসুখ বেশি দেখা যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, চিকিৎসার অভাবে তখন অনেক পথশিশু মৃত্যুর মতো ভয়াবহ পরিণতির শিকার হয়। এমন পরিস্থিতিতে পথশিশুর শীতকালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উষ্ণ পোশাকের ও আশ্রয় নিশ্চিত করা জরুরি।
এরই মধ্যে দেশের সর্বত্র শীতের প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। এ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এসব শিশুর জন্য শীতবস্ত্র, খাবার এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এতে তাদের শীতকাল কিছুটা হলেও নিরাপদ ও আরামদায়ক হবে। প্রতি বছর শীতকালে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি আয়োজন করে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অধিকাংশ পথশিশু এ উদ্যোগগুলোর বাইরেই থেকে যায়। তাই আমাদের সবার পথশিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। আমাদের বাড়তি শীতবস্ত্র কিংবা আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। তা ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে পথশিশুগুলো অন্তত শীতের রাতগুলো উষ্ণতার মধ্যে কাটাতে পারে এমন সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
মনে রাখা জরুরি, পথশিশুরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো এবং তাদের সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। পথশিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার মাধ্যমেই একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। তাই শীতকালে পথশিশুদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সবার এগিয়ে আসা উচিত। সর্বোপরি, পথশিশুর শীতকাল হোক নিরাপদ—এটাই প্রত্যাশা।
মো. সাইফুল মিয়া, শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও
সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়