ড. জাহেদ আরমান
প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:০৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

রাজনৈতিক মিম-সংস্কৃতি, জনমতের যুদ্ধক্ষেত্র 

ড. জাহেদ আরমান। ছবি : সৌজন্য
ড. জাহেদ আরমান। ছবি : সৌজন্য

গণমাধ্যমে দেখলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) আবু সাদিক কায়েম অনলাইনে ‘অপপ্রচার’ ও নারী নেত্রীদের সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগে কয়েকটি ফেসবুক পেজ ও ব্যক্তিগত আইডির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। গত ১ ডিসেম্বর বিকেলে তিনি রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলার এজহারে যেসব পেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি কয়েকটি মিম ও ট্রল পেজও রয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে—মিম ও ট্রল পেজের বিরুদ্ধে কেন এমন ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিল? কারণ সাধারণত ব্যবহারকারীরা জানেন যে, এসব পেজের কনটেন্ট ব্যঙ্গাত্মক ও হাস্যরসভিত্তিক। তা সত্ত্বেও এসব পেজকে মামলার আওতায় আনার ঘটনা অনলাইনে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সাদিক কায়েম সাইবার মামলা করে অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করেছে।

চলুন জেনে নিই রাজনৈতিক মিম কী? মিম মূলত এমন ভিজ্যুয়াল বা টেক্সটনির্ভর অনলাইন কনটেন্ট, যা হাস্যরস, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ বা সাংকেতিক ভাষার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতা, নীতি, নির্বাচন বা সাম্প্রতিক সামাজিক ঘটনাবলি নিয়ে মন্তব্য প্রকাশ করে। অনেকেই এটিকে নিছক হাস্যরস বা বিনোদনের উপাদান বলে মনে করেন। কিন্তু বাস্তবে রাজনৈতিক মিম এখন বাংলাদেশের জনমত গঠন, প্রচারণা এবং রাজনৈতিক ক্যাম্পেইনের অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার।

বাংলাদেশের ডিজিটাল জনপরিসরে আজ যে সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত, দ্রুত-প্রসারিত এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক ভাষাটির বিকাশ ঘটছে, তা হলো—রাজনৈতিক মিম। গত ১৫ বছরের স্বৈরচারী রাজনৈতিক পরিবেশে যেখানে সরাসরি সমালোচনা করা অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, সেখানে মিম একটি ‘সেফার স্পেস’ তৈরি করেছে। ব্যঙ্গ, রসিকতা ও সাংকেতিক ভাষায় কঠোরতম সমালোচনাও প্রকাশ করা যায়—এবং তাতে সেন্সরের হাত অনেক সময় পৌঁছায় না। তাই মিম হয়ে উঠেছে জন-অসন্তোষ ও রাজনৈতিক বার্তা প্রকাশের বিকল্প মাধ্যম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার আগে শুধু সংবাদ মাধ্যমই তথ্য প্রকাশ করতে পারতো। এজন্য সাংবাদিকদের প্রভাব-প্রতিপত্তিও ছিল বেশি। তারা তথ্যের গেইটকিপিং করত। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসাতে তথ্য প্রকাশ অনেক সহজ হয়। সবার হাতের কাছে চলে আসে তথ্য প্রকাশ করার অবারিত সুযোগ। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক দেশে মত প্রকাশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনসহ নানা কালাকানুন করে মতপ্রকাশের অধিকারকে খর্ব করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক মিমের প্রচার প্রসার বাড়তে থাকে।

শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক মিম। এর ব্যবহার প্রথম ব্যাপক মনোযোগ পায় ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ‘Bernie vs. Hillary’, ‘Pepe the Frog’, এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মিম নির্বাচনী ন্যারেটিভকে প্রভাবিত করে। রক্ষণশীল ও উদারপন্থি উভয় শিবিরই মিমকে প্রোপাগান্ডা, বিরোধী শিবিরকে আক্রমণ ও নিজ দলের পক্ষে সমর্থন জোগাড়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। তবে অনেক গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক মিম কখনো কখনো ভোটারদের ভুল তথ্য প্রদান, বিভাজন ও রাজনৈতিক মেরুকরণ বাড়িয়েছে। ফিলিপাইনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর। রদ্রিগো দুতার্তে বা জুনিয়র মার্কোসের মতো নেতাদের সমর্থকরা দীর্ঘ সময় ধরে মিমকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

ফিলিপাইনে মূলত নেতার ভাবমূর্তি জোরদার, প্রতিপক্ষকে তুচ্ছ করা, জনমতকে বিভাজিত করার কাজে মিম ব্যবহার করতে দেখা যায়। থাইল্যান্ডে যেখানে রাজতন্ত্র নিয়ে সরাসরি সমালোচনা দণ্ডনীয়, সেখানে তরুণরা ‘মিম’ ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিবাদকে সাংকেতিক রূপ দিয়েছে। হংকং, থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানের জোট ‘মিল্ক টি অ্যালায়েন্স’-এর মিম এশিয়ার ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজমের নতুন রূপ তৈরি করেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে রাজনৈতিক মিম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ধরনের সাংস্কৃতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বিজেপি সমর্থিত অনলাইন টিম ও কংগ্রেসপন্থি তরুণরা মিমের মাধ্যমে রাজনৈতিক লড়াইকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। ভারতের রাজনৈতিক মিমে প্রায়ই দেখা যায়, জাতীয়তাবাদের উত্থান, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিরোধীদের ব্যঙ্গ, এবং রাজনৈতিক ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। ভারতে রাজনৈতিক মিম রাজনৈতিক ব্র্যান্ডিং, আবেগ তৈরির কাজ এবং বড় ইস্যুতে দ্রুত জনমত নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশেও রাজনৈতিক মিম দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে। রাজনৈতিক ব্যঙ্গ, নেতাদের ব্যক্তিগত আচরণের সমালোচনা, সামাজিক আন্দোলনের সমর্থন—সবই মিমে উঠে আসে। ২০২৪ সালের কোটা-বিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিংবা রাজনৈতিক প্রচারণা—সবক্ষেত্রেই মিম জনমত গঠনে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে, রাখছে। মিম অনেক সময় ব্যক্তিগত সমালোচনার জন্য তিরস্কৃত হলেও, একে তরুণদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের নতুন ভাষা বলা যায়।

দেশে দেশে মিমের এই জনপ্রিয়তা একটি বড় প্রশ্নও সামনে নিয়ে আসছে—মিমের ভেতরের তথ্য কি সত্য, নাকি ভুল, বিভ্রান্তি ও প্রোপাগান্ডাকে আরও দ্রুত ছড়িয়ে দিচ্ছে? মিমের চ্যালেঞ্জ হলো, এগুলো সাধারণত ফ্যাক্টচেকিংয়ের আওতার বাইরে থাকে। সংবাদ প্রতিবেদন বা রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো স্পষ্ট দাবি না থাকায়, মিমকে সর্বদা ‘হাস্যরস’ বা ‘মতামত’ হিসেবে দেখানো যায়। এর সুযোগ নিয়ে অনেক রাজনৈতিক শিবির ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত ছবি, ভুল প্রেক্ষাপট বা অতিরঞ্জিত ক্যাপশন তৈরি করে। ফলে একটি মিথ্যা দাবি সত্য সংবাদ থেকেও বেশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও মিমের এই অপব্যবহার দেখা যায়। মিমের আড়ালে ব্যক্তিগত মর্যাদাহানি, লিঙ্গবিদ্বেষ বা রাজনৈতিক চরিত্রহনন সহজেই করা হয়, অথচ আইনি বা নৈতিক জবাবদিহি তুলনামূলক দুর্বল। আবার অন্যদিকে, রাজনৈতিক দমন বা কঠোর আইনের যুগে মিম ছিল ভয়ের ভেতরেও মতপ্রকাশের নিরাপদ ভাষা—এটিও সত্য। অর্থাৎ, মিম একইসঙ্গে স্বাধীনতা ও অপব্যবহারের দুটি দিকই বহন করে। এখন ব্যবহারকারীকে ঠিক করতে হবে মিমকে কীভাবে দেখবেন।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক মিম আর তুচ্ছ নয়; এটি নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মাধ্যম, নতুন ধরনের প্রতিরোধের ভাষা, এবং রাজনৈতিক প্রচারণার গেম-চেঞ্জার। যারা বাংলাদেশের রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করছেন, তাদের এখন মিম-সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করতেই হবে। কারণ আজকের মিমই কখনো কখনো আগামী দিনের জনমত গঠনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে।

লেখক : ড. জাহেদ আরমান, রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন বিশেষজ্ঞ

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আলোকিত সমাজ গড়তে শিক্ষকদের জন্য উন্নত কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই: মাসুদ সাঈদী

মওলানা ভাসানী সেতু সড়কে ‘লাল নিশান’

চবি শিক্ষার্থীকে উদ্ধার ও নিরাপত্তা জোরদারের দাবিতে মানববন্ধন

শেবাচিমের লাখ লাখ টাকার ইলেকট্রিক সামগ্রী পানির দরে বিক্রি

সৌদি আরবে দ্গ্ধ হয়ে বাংলাদেশি যুবকের মৃত্যু

ইসলামী আন্দোলন ছেড়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন মুফতি হাবিবুর রহমান

তসবিহ হাতে খুনিদের ফাঁসি চাইলেন ইমরানের মা

ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেপ্তার

চাঁদার টাকা না পেয়ে ব্যবসায়ীকে গুলি

সৌদিতে ভারী বৃষ্টিতে ভূমিধস

১০

কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি দমনে মাঠ ভিত্তিক ক্রীড়া পরিচালনার আহ্বান চসিক মেয়রের

১১

আইইএলটিএসে ৮০ হাজার প্রার্থীর ভুল ফলাফল, বাংলাদেশে প্রশ্নফাঁস

১২

ধান ক্ষেত থেকে ভেসে আসছিল নবজাতকের কান্না

১৩

শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বিজয় দিবস / পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশ

১৪

অভিযানে নেশা জাতীয় ট্যাবলেট জব্দসহ আটক ১

১৫

রাত ১১টা হলেই বন্ধ থাকে গ্যাস সরবরাহ, এলাকাবাসীর ক্ষোভ

১৬

নিখোঁজের ৩৩ বছর পর বাড়ি ফেরা সেই মোবারক মারা গেছেন

১৭

বরিশালে হেনস্তার ঘটনা নিয়ে মুখ খুললেন ফুয়াদ

১৮

সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী মঙ্গলবার

১৯

বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা না হলে যে পথে এগোতে চায় জমিয়ত

২০
X