সাম্প্রতিক সময়ই শুধু নয়, বেশ পূর্ব থেকেই বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে মাদক ক্রয়ের টাকা না পেয়ে মা-বাবাকে অনেক সন্তান হত্যা ও নির্যাতন করছে। আবার অনেক বাবা-মা নেশাগ্রস্ত সন্তানকে মাদকমুক্ত করতে তাদের সন্তানদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করছে। দুটি ঘটনাই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার বিষয়।
বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে বেশি প্রিয় আর কী হতে পারে? তবু প্রিয় সন্তানগুলোকে পুলিশে দিচ্ছে একটাই উদ্দেশ্য—সন্তানদের কল্যাণ। নিজে অপারগ হয়ে সন্তানকে ভালো করতে পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছে। কোনো পিতা-মাতা এ ধরনের নেশার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তার সন্তানরা নেশাগ্রস্ত হোক; এটা কিন্তু চায় না। তামাক, বিড়ি, সিগারেট, গুল, আলা-পাতা, জর্দা প্রাথমিকভাবে এগুলো দিয়ে শুরু, ফেনসিডিল, প্যাথেডিন, মদ, হেরোইন, সর্বশেষ ইয়াবা বড়িতে এসে পৌঁছেছে। মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস আছে, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আছে, শিক্ষা কারিকুলামে মাদকের ক্ষতিকর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করার উদ্যোগ আছে। বিড়ি সিগারেট জর্দার প্যাকেটেও এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করার ব্যবস্থা আছে, তবু এতে কেন যেন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না— এর উত্তর নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষই দিতে পারবেন। সর্বোপরি এগুলো ব্যবহারের অপরাধে জেল-জরিমানার আইনগত ব্যবস্থা আছে। সব ব্যবস্থাই যেন রেজিট্যান্স পাওয়ার হারিয়েছে। যেন কোনোটাতেই কাজ হচ্ছে না। ক্রনিক ডিজিজের মতো আরোগ্য-যোগ্য নয়।
সর্বশেষ মাদক ব্যবসায়ীদের ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যার মধ্য দিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণের ঘটনাই পূর্বের ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করছে। আর এই ক্রসফায়ার নিয়ে শুধু মানবাধিকার কর্মী, সচেতন জনতা, রাজনৈতিক দলই শুধু সোচ্চার নয়। স্বয়ং সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরাও সরব হয়েছেন মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে। মাদক সেবন মাদক সেবিদের ধীরে ধীরে অসুস্থ ও কর্মহীন করে তুলছে। এতে ব্যক্তি ও পারিবারিক ক্ষতিই শুধু হচ্ছে না, দেশ-জাতি বঞ্চিত হচ্ছে সেসব মানুষের সামাজিক সেবা, উৎপাদনশীলতা থেকে। অজানা-অদেখা বা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের কৌতূহল একটু বেশি থাকে। যুব সমাজের অতি উৎসাহী মনোভাব, অভিভাবকের প্রাথমিক পর্যায়ে সন্তানদের প্রতি খেয়াল না করা, হাত খরচ বাবদ বেহিসেবি অর্থ সরবরাহ, ভালো সঙ্গের সঙ্গে চলাফেরা না করা, সর্বোপরি মাদক প্রাপ্তির সহজলভ্যতা এবং সামাজিক প্রতিরোধের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকার কারণে মাদকের প্রতি ঝুঁকছে মানুষ। তামাক, জর্দার পণ্যে সরাসরি বিজ্ঞাপন প্রদানের ব্যবস্থা না থাকলেও তামাকজাত দ্রব্যের কোম্পানিগুলো যেভাবে সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ (এসআর) বা বিক্রয় প্রতিনিধি হাঁটে-ঘাটে বাজারে নামিয়েছে, ছোটখাটো দোকান, বাস, স্টিমার, লঞ্চ, ফেরি ও ট্রেন লাইন জনবহুল এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করছে; তাতে মাদকজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেশের কৃষি জমিতে তৈরি হচ্ছে তামাক। কোম্পানিগুলো কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করতে আগাম টাকা দিচ্ছে, পরে তামাক নিয়ে টাকা উসুল করছে। তামাক কোম্পানির কাছ থেকে বড় অঙ্কের ট্যাক্স পাচ্ছে এমন অজুহাতে তামাকের ব্যবসাকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই সহায়তা করা হচ্ছে। অন্যদিকে মাদকের ব্যবসার সঙ্গে ইদানীং যারা জড়িত হয়েছে, তাদের মধ্যকার শক্তিশালী ও নীতিনির্ধারণকারী সমাজের কিছু সংখ্যক এলিট, রাজনীতিক, পুলিশ প্রশাসনের লোক। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন মিডিয়ার অনুসন্ধানী রিপোর্টে সেটি আরও পরিষ্কার হয়েছে। মধ্য পর্যায়ে সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক কর্মী, বস্তিবাসী, ছিন্নমূল শিশুদের মাধ্যমে এগুলোর বাজারজাত করছে। সবসময়ই দেখা যায়, পুলিশ প্রশাসনের মুষ্টিমেয় মানুষ এবং ক্ষমতাসীন রাজনীতির কিছু লোকের কারণে এটা প্রতিরোধ কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় প্রশাসনের হাতে ধরা পড়লেও ক্ষমতাসীনদের প্রভাবে বিচারকের কাঠগড়ায় যাওয়ার আগেই ছাড়া পেয়ে যায়। আইনের শাসনের ঘাটতি, এমনকি প্রয়োগের অভাবে আজ মাদকের ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ক্রস ফায়ারের মতো অবিচারিক পথ অনুসরণ করতে হয়। একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে বিচার ছাড়া মানুষ হত্যা, সে যত বড় অপরাধীই হোক কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। পৃথিবীর অনেক দেশে বিচারের মাধ্যমেও মানুষকে হত্যার বিধান রহিতকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।
এ কথা সত্য, জ্ঞানীদের জ্ঞানী মনীষী সক্রেটিস বলে গিয়েছেন, ‘মানুষ জ্ঞানের আধার’—মানুষকেই নিয়ে পৃথিবীর সব কর্মকাণ্ড। সেখানেই মানুষ মেরে নয়, বাঁচিয়ে রেখেই তাকে সংশোধন করতে হবে। এজন্য আইন, বিচার, শাসন থাকবেই। তবে সেইসঙ্গে বেশি যেটা প্রয়োজন, সেটা হলো মানুষকে আত্মোপলব্ধির জায়গায় আনার প্রয়োজন, সচেতন করার প্রয়োজন, নৈতিক শক্তিকে শানিত করার দরকার।
সামাজিক সচেতনতা এবং নৈতিক শিক্ষা সব অনাচার প্রতিরোধে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ক্লাব বা সমিতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক, মৌলবি, উন্নয়নকর্মী, সমবায় কর্মী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের এ কাজের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মাদক নিরসনে সামাজিক সচেতনতা আর প্রতিরোধই প্রধান উপায় হতে পারে। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা এবং মাদকসেবী অথবা ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক শেল্টার প্রদান বন্ধ করা জরুরি। প্রশাসন আর রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল যদি মনে করে সমাজ থেকে মাদক, চাঁদাবাজি নির্মূল করবে, তাহলে কোনোভাবেই এটা সমাজে থাকার কথা নয়। ফসল রক্ষায় বেড়া দেওয়া হলো, সেই বেড়াতেই যদি ফসল খায় তাহলে যেমন ফসল রক্ষা হবে না, তেমনি যাদের দায়িত্ব এগুলো দমন করা, তারাই যদি প্রতিরোধ না করে এর সঙ্গে যুক্ত থাকে বা সহায়তা করে, তাহলে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। মিডিয়ার অনুসন্ধানী রিপোর্ট ও পুলিশ প্রশাসনের তালিকায় মাদকের সঙ্গে যুক্ত থাকায় যাদের নাম এসেছে, তাদেরই আগে সংশোধন করা প্রয়োজন। কোনো এমপির গাড়িতে ইয়াবার চালান গেলে সেটা ধরার ক্ষমতাও সাধারণ পুলিশের থাকার বিষয়ে আইনি সুরাহা হওয়া দরকার। এ জন্য সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের আন্তরিকতা আর সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষাই মাদকের ভয়াবহতা থেকে জাতি রক্ষা পেতে পারে। সভ্যতার কারিগর যুবসমাজ। যুগে যুগে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। সেই কারিগরদের কৌশলে চেতনাহীন এবং শারীরিকভাবে অক্ষম করে দিলে সাময়িক সময়ের জন্য শাসক ও শোষকরা রক্ষা পেলেও চূড়ান্ত বিচারে রক্ষা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ইতিহাসই তার বড় উদাহরণ। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচারের ও ফ্যাসিবাদের পতন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণের আন্দোলনও সেই সত্য প্রকাশ করে। যুব সমাজকে ভেবে দেখতে হবে মাদকের নেশায় জীবনপাত বুদ্ধিমানের কাজ নয়। জীবনে অনেক ভালো কাজ করার তাগিদ আছে। তাদের প্রতি জাতির আকাঙ্ক্ষা আছে, সেটা পূরণে তাদের সুন্দর পৃথিবী গড়ার কাজে আগুয়ান হওয়া দরকার। মাদক সেবনে মৃত্যু আর বীরের মৃত্যু এক নয়। বিষয়টি ভেবেই মাদক থেকে দূরে থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার এখনই নিতে হবে।
লেখক: কলেজ অধ্যক্ষ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটি