রামজি বারুদ
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৫, ০৯:০২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ন্যায়ের প্রশ্নে পশ্চিমা দ্বিমুখিতা

ন্যায়ের প্রশ্নে পশ্চিমা দ্বিমুখিতা

আন্তর্জাতিক আইন এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এর ভবিষ্যৎ ঠিক করবে বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্ষমতাধর দেশগুলোর ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যার মাধ্যমে টিকে ছিল।

আদর্শগতভাবে, আন্তর্জাতিক আইন সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত ছিল—বিশেষ করে ছোট-বড় সব দেশের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক রাখতে এবং যুদ্ধ শুরুর আগেই সমস্যার সমাধান করতে। এমনকি এ আইন যদি সত্যিকারের কার্যকর হতো, তাহলে পশ্চিমা উপনিবেশবাদ যেভাবে গ্লোবাল সাউথকে শত শত বছর ধরে দাসত্বে পরিণত করেছিল, সেটার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যেত।

কিন্তু বাস্তবে, আন্তর্জাতিক আইন যেন শুধু ক্ষমতাবানদের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার। শান্তি প্রতিষ্ঠা বা উপনিবেশ মুক্তির জন্য এ আইন তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখেনি।

ইরাক, আফগানিস্তান কিংবা লিবিয়ায় হামলা থেকে শুরু করে বর্তমানের বিভিন্ন ঘটনা পর্যন্ত দেখলে বোঝা যায়, জাতিসংঘ বেশিরভাগ সময় শক্তিশালী দেশগুলোর ইচ্ছা দুর্বলদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর যখন ছোট দেশগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একসঙ্গে লড়তে চায়, তখনই দেখা যায় ভেটো ক্ষমতার দোহাই দিয়ে বড় দেশগুলো তাদের পথ রুদ্ধ করে দেয়।

তাই এখন গ্লোবাল সাউথের অনেক মানুষ বলছেন, আন্তর্জাতিক আইন আসলে কেবল মুখের কথা। শান্তি, মানবাধিকার আর ন্যায়ের বড় বড় বুলি আওড়ানো হয় ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে এর কোনো মূল্য নেই।

গাজায় গণহত্যা আর আন্তর্জাতিক আইনের ব্যর্থতা : এ অপ্রাসঙ্গিকতা সবচেয়ে প্রকটভাবে দেখা গেছে ইসরায়েলের ১৫ মাসের গাজায় হামলায়। হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মারা গেছে, আহত হয়েছে লাখের কাছাকাছি। চিকিৎসা গবেষণাগুলো বলছে, এ সংখ্যা আরও বাড়বে। তবে যখন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) গাজায় সম্ভাব্য গণহত্যার তদন্ত শুরু করল এবং পরে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব অবৈধ বলে রায় দিল, তখন মনে হলো—আন্তর্জাতিক আইন হয়তো এখনো কিছুটা সচল। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) যখন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী গালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করল, তখন বোঝা গেল এ পশ্চিমা আইন ব্যবস্থাতেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এসবের বিরুদ্ধে সরব হলো। এটা তো নতুন কিছু নয়, ওয়াশিংটন বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক জবাবদিহি এড়িয়ে চলতে চায়। ২০০২ সালে মার্কিন কংগ্রেস এমন একটি আইন পাস করেছিল, যাতে আইসিসি কোনো মার্কিন সেনাকে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করতে না পারে। এমনকি আইসিসি যদি কোনো মার্কিন নাগরিককে আটক করে, তাহলে তাকে মুক্ত করতে সামরিক শক্তি ব্যবহারের অনুমতিও দেওয়া হয়েছিল! আর এরকম বেশিরভাগ পদক্ষেপের লক্ষ্য একটাই—ইসরায়েলকে রক্ষা করা।

ইসরায়েলকে বাঁচাতে পশ্চিমা মরিয়া চেষ্টা

গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার পর বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। ইসরায়েল প্রথমবারের মতো এমন এক নজরদারির মুখে পড়েছে, যা তাকে কার্যত একঘরে করে তুলেছে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের নীতি বদলানোর বদলে উল্টো যুদ্ধবিরতির পক্ষে কথা বলা নাগরিক সমাজের ওপর চড়াও হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও টার্গেট করা হচ্ছে।

১৮ ফেব্রুয়ারি জার্মানির পুলিশ Junge Welt পত্রিকার অফিসে অভিযান চালায়, যেন তারা কোনো ভয়ংকর সন্ত্রাসী ধরতে যাচ্ছে! কারণটা ছিল ফ্রান্সেস্কা আলবানেজের বক্তব্য—তিনি একজন ইতালীয় আইনজীবী ও জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত, যিনি গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের কড়া সমালোচক।

যদি জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ না করত, তাহলে শুধু ইসরায়েলের অপরাধের জন্য জবাবদিহি চাওয়ার অপরাধে আলবানেজকে গ্রেপ্তার করা হতে পারত! তবে শুধু জার্মানি নয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশও এ নৈতিক সংকটের অংশ হয়ে গেছে। তারা শুধু ইসরায়েল আর নিজেদের রক্ষা করতে চায় না, বরং আন্তর্জাতিক বিচারক ও সংস্থাগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতেও পিছপা হচ্ছে না।

১৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি কারিম খানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, কারণ তিনি ইসরায়েলের নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছিলেন। খান যা করেছেন, তা আগে কেউ করেনি—ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়েছিলেন। এখন নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট ‘যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ’-এর দায়ে অভিযুক্ত।

আশার আলো কোথায়?

এ সংকটের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, যারা আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারাই এখন অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হচ্ছে! কারিম খান পশ্চিমা গণমাধ্যমে কটাক্ষের শিকার হয়েছেন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তার ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে।

তবে সব অন্ধকারের মধ্যেও আশার আলো আছে। এই পুরো পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক আইন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কারের একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। যেখানে বিচার সবার জন্য সমান হবে, যেখানে ক্ষমতাবানদের জন্য আলাদা আইন থাকবে না। যারা এখনো ইসরায়েলকে সমর্থন করছে, তারা কার্যত আন্তর্জাতিক আইনকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।

গাজার যুদ্ধ যদি কিছু শেখায়, তবে সেটা হলো এখন সময় এসেছে এমন একটা বিশ্ব গঠনের, যেখানে ক্ষমতাবানরা নয়, বরং ন্যায়ের ভিত্তিতেই সবকিছু চলবে। যেখানে নিরপরাধ শিশুরা মরবে না, যেখানে সামরিক শক্তি নয়, বরং ন্যায্যতাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হবে।

লেখক: প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতি, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, বিশেষ করে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণা করে থাকেন। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন আবিদুর রহমান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নিজ বাসভবনে হামলার শিকার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী

ই-কারের ভাড়া ৫ টাকা করার দাবি চবি ছাত্রশিবিরের

কেশবপুরে নারী সমাবেশ অনুষ্ঠিত 

বিশ্বসুন্দরী মঞ্চে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনি নাহিন আইয়ুব

স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা তুষার নিখোঁজ

নীরবে শরীরে যে ৭ ক্ষতি করছে ইউরিক অ্যাসিড

ডুবুরিদের ৩ ঘণ্টার চেষ্টাতেও সন্ধান মেলেনি শিশু নাজিমের

ভাত ছেড়ে দিলেই কি ওজন কমবে? যা বলছেন পুষ্টিবিদ

কানাডা মাতাতে যাচ্ছেন জায়েদ খান

মৃত্যুর কারণ চিরকুটে লিখে গেলেন নাসরিন

১০

সড়কে মিলল ৬ পুরুষের কাটা মাথা, দেহ গায়েব

১১

ড্যাবের নবনির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর

১২

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ৫৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

১৩

ইরান থেকে বিতাড়িত আফগানদের দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ল না, নিহত ৭১

১৪

দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে আজ

১৫

২০ আগস্ট : আজকের রাশিফলে কী আছে জেনে নিন

১৬

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

১৭

ওসির স্বাক্ষর জাল করে ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ, পুলিশ সদস্যের নামে মামলা

১৮

বায়ুদূষণের শীর্ষে জাকার্তা, ঢাকার খবর কী?

১৯

টিভিতে আজকের খেলা

২০
X