তারেক খান
প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কোথায়

রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কোথায়

বিশ্বজুড়ে বহু জাতিগোষ্ঠী নানা সময়ে নিজ ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদ, নির্যাতন ও জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তবে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম মানবিক সংকট হিসেবে বিবেচিত হয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুঃখগাথা। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে শত শত বছর ধরে বসবাসকারী এই মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আজ গৃহহীন, রাষ্ট্রহীন এবং চরম নিরাপত্তাহীনতায় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করেছে এবং বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত দমনপীড়ন, গণহত্যা ও নারী-শিশু নির্যাতনের ফলে লাখ লাখ মানুষ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। এ সংকট শুধু মানবিক নয়, এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা, অর্থনীতি, কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতাকে ঘনীভূত করেছে।

আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ, শুরু ও ধারা: রোহিঙ্গাদের পরিকল্পিতভাবে উচ্ছেদ শুরু হয় ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার একটি বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে, যেখানে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বাদ দেওয়া হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে সহিংসতা, সেনা অভিযান এবং দমনপীড়নের মাধ্যমে তাদের বিতাড়ন করা হয়। ২০১৭ সালে ভয়াবহ সেনা অভিযানে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, যা আন্তর্জাতিক মহলে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ হিসেবে স্বীকৃত। রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের পেছনে মূল ভূমিকায় রয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবস্থান ও সংখ্যা: বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। যেমন সৌদি আরবে প্রায় ২ লাখ, পাকিস্তানে প্রায় ৩ লাখ, মালয়েশিয়ায় প্রায় ১ লাখ, ভারতে ৪০ হাজারের বেশি। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্য বিভিন্ন দেশেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা বসবাস করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল এবং অনিবন্ধিত।

মিয়ানমারে বর্তমান রোহিঙ্গা জনগণের সংখ্যা ও অবস্থা: ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইন রাজ্যে এখনো প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এদের বেশিরভাগ সেনা নিয়ন্ত্রিত অভ্যন্তরীণ ক্যাম্পে বসবাস করছে। চলাচল, শিক্ষা, চিকিৎসা, কাজের সুযোগসহ মৌলিক অধিকারের ঘাটতি তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সহায়তা ছাড়া তাদের টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধপ্রবণতা: বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি অংশ মাদক পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, অপহরণ ও ভুয়া পরিচয়ে পাসপোর্ট প্রাপ্তির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষত কক্সবাজার ও সীমান্তবর্তী এলাকায় ইয়াবা পাচার এখন অন্যতম বড় সমস্যা, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ: রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য কেবল একটি মানবিক নয়, একটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও বটে। সীমিত ভূখণ্ডে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার উপস্থিতি জনসংখ্যা, পরিবেশ ও অবকাঠামোর ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করেছে। খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সংঘর্ষও বাড়ছে। সুশৃঙ্খল জীবনব্যবস্থা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে উঠেছে এবং রেশন সংকোচনের ফলে চুরি, ছিনতাই, মানব পাচার ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আশঙ্কা বাড়ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে আইনশৃঙ্খলা অবনতির ঝুঁকি বাড়ছে, বিশেষ করে ক্যাম্পে জন্মগ্রহণকারী নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ এক অন্ধকারময় গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে।

অর্থায়ন ও দাতাসংস্থার ভূমিকা: রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিচালনায় মূল অর্থায়ন করে আসছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠী, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো WFP, UNHCR, UNICEF, IOM, EU ইত্যাদি। তবে সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এই সহায়তা ক্রমেই কমে এসেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) রোহিঙ্গাদের মাসিক খাদ্য সহায়তা সাড়ে ১২ ডলার থেকে ৬ ডলারে নামানোর পরিকল্পনা করেছিল, যা পরবর্তীকালে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সফরের পর কিছুটা রিভাইজড হয়। খাদ্য সহায়তা সংকুচিত হলে নারী ও শিশুদের অপুষ্টি, পাচার, বাল্যবিবাহ ও গার্হস্থ্য সহিংসতার ঝুঁকি বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার বিকল্প তহবিল ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ তৈরিতে সক্রিয় রয়েছে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি: রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, যেখানে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশগুলোর অবস্থান একেক রকম। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পক্ষপাতী হলেও মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার অভাব ও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের কারণে সংকটটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক জবাবদিহি থেকে অনেকাংশে রক্ষা করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্যাম্পে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে রোহিঙ্গাদের যুক্ত করার প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশ তা পুরোপুরি গ্রহণ করেনি।

পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় বাস্তবতা ও সদিচ্ছা: মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তাদের সদিচ্ছার অভাব প্রকট। ২০১৭ সালের পর একাধিকবার দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও চুক্তি হলেও আজ পর্যন্ত কোনো প্রত্যাবাসন বাস্তবায়িত হয়নি। জাতিসংঘ, চীন ও বাংলাদেশের ত্রিপক্ষীয় সহায়তায় ২০২৩ সালে ফের একবার ‘পাইলট রিটার্ন প্রকল্প’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে তা কার্যকর হয়নি। রোহিঙ্গারা বারবার বলেছে—নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও জমির নিশ্চয়তা ছাড়া তারা ফিরবে না। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এখনো তাদের নাগরিকত্ব স্বীকৃতি দেয়নি, বরং এনভায়রনমেন্টাল আইডি কার্ড (NVC) নামক একটি অস্থায়ী পরিচয়পত্র প্রদানে আগ্রহী, যা রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণভাবে ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে।

প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা বর্তমানে অত্যন্ত অনিশ্চিত ও দুরাশার পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রথমত, মিয়ানমার এখন এক অস্থিতিশীল দেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে সামরিক জান্তা ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে প্রায় প্রতিদিন সংঘর্ষ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরলেও নাগরিকত্ব না পাওয়া, নিরাপত্তাহীন পরিবেশে বাস, স্বাধীন চলাফেরার অভাব এবং বসতভিটা পুনঃপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা না থাকা তাদের ফেরার আগ্রহকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সহায়তা ও চাপও এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়, ফলে বাংলাদেশ সরকার একপ্রকার কূটনৈতিক একঘরে অবস্থানে চলে গেছে। এতে প্রত্যাবাসনের কোনো কার্যকর কাঠামো বা টাইমলাইন দৃশ্যমান নয়।

ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার ও আরসার অবস্থান: বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুকে শান্তিপূর্ণ, স্বেচ্ছা ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে সমাধানের পক্ষে। তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান ভিন্ন। চীন বরাবরই মিয়ানমারের পক্ষ অবলম্বন করে আন্তর্জাতিক চাপ রোধে সহায়তা করে আসছে। ভারত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা হুমকি মনে করে এবং নিজ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তাদের কূটনৈতিক চাপ এখনো বাস্তব প্রত্যাবাসনে পরিণত হয়নি। মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক সমালোচনার পরও জান্তা ও সেনা সরকারের মাধ্যমে পুনর্বাসনের দাবি করছে, যা রোহিঙ্গাদের কাছে অনিশ্চয়তার নামান্তর। অন্যদিকে, আরসা (Arakan Rohingya Salvation Army) সামরিক প্রতিরোধে সক্রিয় থাকলেও, তারাও প্রত্যাবাসনের রাজনৈতিক সমাধানে অনুপস্থিত।

রোহিঙ্গা সংকট একটি বহুমাত্রিক সমস্যা—মানবিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত—যার সমাধানে শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও সমানভাবে সক্রিয় হতে হবে। বর্তমান বাস্তবতা হলো, দীর্ঘমেয়াদি আশ্রয়ের ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী স্থানীয়ভাবে অপরাধপ্রবণতা, সামাজিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা তৈরি করছে। অথচ আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে আসছে এবং মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন অঞ্চলভিত্তিক কৌশল, চীনের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং জাতিসংঘের সমন্বিত হস্তক্ষেপ। একমাত্র বাস্তব, মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনই হতে পারে এ সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধান। তা না হলে, দক্ষিণ এশিয়ার হৃদয়ে একটি স্থায়ী মানবিক ও নিরাপত্তা সংকট অব্যাহত থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বর্ণাঢ্য আয়োজনে স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগে নবীনবরণ

খুলনা সদর আসনে ধানের শীষের দাবিদার যারা

দিনদুপুরে প্রকাশ্যে যুবককে গলা কেটে হত্যা

প্ল্যান গণমাধ্যম পুরস্কার পেলেন কালবেলার জাফর ইকবাল

কুয়াকাটায় ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ নারীর মৃত্যু

১১ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল

এইচএসসি পরীক্ষার ফল পুনর্নিরীক্ষণের তারিখ জানাল শিক্ষা বোর্ড

রামাল্লায় পৌঁছেছে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বহনকারী বাস

রাকসু নির্বাচন  / ‘আকাশকুসুম’ ইশতেহারে ভোটার টানার চেষ্টায় প্রার্থীরা

বিইউবিটিতে শিক্ষক দিবস উদযাপন

১০

সুন্দর সমাজ গঠনে সৃজনশীলতাকে প্রাধান্য দিতে হবে : সাদিক কায়েম

১১

কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণা

১২

ইসরায়েলের সব জিম্মিকে মুক্তি দিল ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা

১৩

নবীনদের বরণ করে নিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

১৪

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখার ২ নেতা গ্রেপ্তার

১৫

স্পিড স্কেটিংয়ে জোড়া স্বর্ণপদক জিতলেন পৃথিবী

১৬

এনসিপি শাপলা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে : সারজিস

১৭

একটি দল চাঁদাবাজকে ফুল দিয়ে বরণ করেছে : স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি

১৮

প্রতিবন্ধী শিশুকে হুইলচেয়ার উপহার দিলেন তারেক রহমান

১৯

নভেম্বরে গণভোট চায় জামায়াতে ইসলামী

২০
X