মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮ ভাদ্র ১৪৩২
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৪৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দখলদার ইসরায়েল কি অপ্রতিরোধ্য

দখলদার ইসরায়েল কি অপ্রতিরোধ্য

ইসরায়েল পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র। জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যের স্বীকৃতি সত্ত্বেও বিশ্বের ২৮টি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করেনি। ভৌগোলিকভাবে দেশটি ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব তীরে ও লোহিত সাগরের উত্তর তীরে অবস্থিত। এর উত্তর স্থলসীমান্তে লেবানন, উত্তর-পূর্বে সিরিয়া, পূর্বে জর্ডান ও ফিলিস্তিন (পশ্চিম তীর), পশ্চিমে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ড এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে মিশর অবস্থিত।

ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত তেল আবিব হলো দেশটির অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত প্রাণকেন্দ্র ও বৃহত্তম মহানগর এলাকা। ইসরায়েল সমগ্র জেরুজালেম শহরকে নিজের রাজধানী হিসেবে দাবি করে আসছে, যদিও এ মর্যাদা সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রই স্বীকার করে না। ইসরায়েলে অধিকাংশ দেশের দূতাবাস তেল আবিব নগর বা জেলায় অবস্থিত। শহরের পশ্চিমভাগ ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং এখানে দেশটির সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অবস্থিত।

অর্থনৈতিকভাবে ইসরায়েল অত্যন্ত উন্নত শিল্পপ্রধান রাষ্ট্র এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের হিসেবে ইসরায়েল বিশ্বের ৩৪তম বৃহত্তম অর্থনীতি। ইসরায়েল অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, তিনটি উচ্চ-আয়ের রাষ্ট্রগুলোর একটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, এটি বিশ্বের ৩৯টি অগ্রসর অর্থনীতিসমৃদ্ধ দেশগুলোর একটি। ইসরায়েল নিজেকে একটি ইহুদিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে। এখানে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। দেশটির এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার নাম ক্নে‌সেত। প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম, ইতিহাস ও রাজনীতি মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বেশ কয়েকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এটি ১৯৬৭ সাল থেকে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা সামরিকভাবে দখল করে আছে। ঘটনাটি আন্তর্জাতিকভাবে আধুনিক ইতিহাসের দীর্ঘতম সামরিক দখলের ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০২১ সালে এসে জাতিসংঘের ১৯২টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৬৪টি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ২৮টি রাষ্ট্র (মূলত মুসলমান অধ্যুষিত) এখনো ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়নি। এর সঙ্গে তাদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। তাদের মতে, ইসরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের একটি অংশের অবৈধ দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে ঐতিহাসিক গবেষণা ও দালিলিক যুক্তি-প্রমাণসহ দাবি করা হয় যে, ইসরায়েলি সরকার অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে। সংস্থাটির মতে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনিদের জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন মাত্রায় তাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে গণহারে ভূমি জবরদখল, অব্যাহতভাবে ইসরায়েলি বসতি নির্মাণ ও সুউচ্চ প্রাচীর নির্মাণ করে ফিলিস্তিনিদের ছিটমহলে অবরুদ্ধকরণ ও বলপূর্বক পৃথকীকরণ, তাদের বসবাসের অধিকার ও নাগরিক অধিকার হরণ এবং তাদের ওপর দমন-নিপীড়নের মতো কাজগুলো সম্পাদন করে চলেছে। কিছু কিছু এলাকায় এ ধরনের বৈষম্য এতই প্রবল যে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ইসরায়েলি সরকারের আচরণগুলো সীমা লঙ্ঘন করেছে এবং এগুলো জাতিবিদ্বেষভিত্তিক পৃথকাবাসন (আপার্টহাইট) ও নিপীড়নের মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। এর আগে ২০১৭ সালে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবৃতি দেয় যে, ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূমি জবরদখল, ছয় লাখ ইহুদির জন্য ২৮০টির মতো অবৈধ বসতি স্থাপন, ফিলিস্তিনিদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদের পাশাপাশি অবাধ বৈষম্যমূলক আচরণের দ্বারা প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের কর্মস্থলে গমন, বিদ্যালয়ে গমন, বিদেশে গমন, আত্মীয়দের সাক্ষাৎ, অর্থ উপার্জন, প্রতিবাদে অংশগ্রহণ, কৃষিভূমিতে কাজ করার ক্ষমতা, এমনকি বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানির লভ্যতা, মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার হরণ, আল-আকসাসহ মুসলিমদের পবিত্র ধর্মীয় উপাসনালয়ে গমনাগমনে বাধা সৃষ্টি, নির্বিচারে মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশু হত্যার মতো নারকীয় কাণ্ড ও মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘন করছে।

২০২২ সালের হিসাবে, ইসরায়েলের আনুমানিক ধর্মাবলম্বীর শতাংশ ছিল ৭৩.৫ ভাগ ইহুদি, ১৮.১ শতাংশ মুসলিম, ১.৯ শতাংশ খ্রিষ্টান, ১.৬ শতাংশ দ্রুজ ও ৪.৯ শতাংশ অন্যান্য। ইসরায়েলে অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠী, যেমন বৌদ্ধ ও হিন্দু রয়েছে, যদিও তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এক মিলিয়নেরও বেশি অভিবাসীর মধ্যে প্রায় তিন লাখ জনকে ইসরায়েল ইহুদি হিসেবে গণ্য করে না।

ইসরায়েলের দখলদারত্ব, যা এখন আধুনিক ইতিহাসের দীর্ঘতম সামরিক দখলদারত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়, সেখানে অবৈধ বসতি স্থাপন করেছে। যার ফলে তার দখলদারত্বের অধীনে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের একটি ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যা ইসরায়েলি বর্ণবাদ নামে পরিচিত। এ বৈষম্যের মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের তাদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার এবং তাদের হারানো সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।

২০০৭ সালে ইসরায়েল গাজা উপত্যকার অবরোধ আরও কঠোর করে এবং পশ্চিম তীর থেকে এটিকে বিচ্ছিন্ন করার নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের এক রায়ে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) ইসরায়েলের অবস্থান প্রত্যাখ্যান করে নির্ধারণ করে যে, ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলো একটি রাজনৈতিক ইউনিট গঠন করে এবং ইসরায়েল পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা অবৈধভাবে দখল করে চলেছে। আইসিজে আরও নির্ধারণ করেছে যে, ইসরায়েলি নীতি সব ধরনের বর্ণগত বৈষম্য দূরীকরণ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন লঙ্ঘন করে।

২০০৬ সাল থেকে, হামাস এবং ইসরায়েল বেশ কয়েকটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাস-নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণের পর আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ, গণহত্যা বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করেছে।

পৃথিবীর কোনো সমস্যাই সমাধান করা অসম্ভব নয়। পৃথিবীর তাবড় মুসলিম দেশ থেকে ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েলের পরাজয় হবে বলে রব উঠছে। বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতায় মুসলিম ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রটির প্রতি একই ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি এবং একটি স্থায়ী শান্তি চুক্তি হয়তোবা এ সমস্যার সমাধান হতে পাত। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে হুদায়বিয়ার সন্ধির বিষয়টি। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সন্ধি মুসলমানদের বিপক্ষ শক্তির সঙ্গে করেছিলাম। ওই সন্ধির অধিকাংশ শর্তই মুসলমানদের বিপক্ষে ছিল। খোদ সাহাবি বা সঙ্গীরা হতাশ হয়। এ সন্ধির পরই মক্কা বিজয় হয়। অতঃপর মুসলমানরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, ফিলিস্তিনের অধিকাংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অর্থনৈতিকভাবে লিডিং পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু এ সময় সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান এ যুদ্ধে প্রতিবেশী কোনো দেশ এগিয়ে আসেনি। অন্যদিকে হাজার কিলোমিটার দূর থেকে দখলদার ও হানাদার ইসরায়েলি বাহিনীর সহযোগিতা আসছে। তবে কি দখলদার-হানাদার ইসরায়েল অপ্রতিরোধ্য থেকে যাবে?

এ অবস্থায় পৃথিবীর অন্যতম শান্তিপ্রিয় দেশ এবং একজন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধের বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন, যা এখন সময়ের দাবি। আমার মনে হয় বাংলাদেশের জনগণ এ মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তবে কি আল্লাহই একমাত্র ভরসা ফিলিস্তিনিদের জন্য। আশা করি তিনিই যথেষ্ট হবেন।

লেখক: প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহল

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজীপুরের কমিশনারের দায়িত্ব থেকে সরানো হলো নাজমুল করিমকে

একাত্তরে ভুল করেছেন, এখনো ভুলের রাজনীতিতে আছেন : টুকু

দুই কিংবদন্তি অলরাউন্ডার সাকিব ও সিকান্দারকে ‘এক’ করলেন জুলফিকার!

বিএনপিকে এনসিপির শুভেচ্ছা / ‘আমরা তর্কবিতর্ক করব কিন্তু পারস্পরিক সৌহার্দ্য থাকবে’

পুরো সেপ্টেম্বরের পূর্বাভাস জানাল আবহাওয়া অফিস

নদীতে জাল ফেলা নিয়ে দ্বন্দ্বে হামলা, জেলের মৃত্যু

ক্ষমা চাইলেন রিটকারীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া সেই শিক্ষার্থী

আহত চবি শিক্ষার্থীদের দেখতে চমেকে শাহজাহান চৌধুরী

জাঁকজমক আয়োজনে রুয়েটে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন

দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু

১০

বাঁকখালী নদী উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান শুরু

১১

আনাসসহ সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় বিএফইউজে-ডিইউজের নিন্দা 

১২

ক্যানসারে আক্রান্ত সাংবাদিক মেহেদী বাঁচতে চান

১৩

বুকে রড ঢুকিয়ে যুবককে হত্যা

১৪

মব সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে : বুলু

১৫

ইসরায়েলের তেলবাহী ট্যাংকারে ইয়েমেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

১৬

নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহে ওয়াসাকে আহ্বান চসিক মেয়রের

১৭

স্বর্ণের দাম আবারও বাড়ল, ২২ ক্যারেট কত?

১৮

‘দেশের স্বাধীনতা ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম জেনারেল ওসমানী’

১৯

স্পেনের বিপক্ষে ফিনালিসিমার তারিখ নিয়ে ক্ষুব্ধ স্কালোনি

২০
X